বাক্‌ ১৪৮ ।। তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়


 

বাতাসদশা

 

অপূর্ব বাতাসদশা বহু শ্রমে পাওয়া; একে খাই বা না-খাই, অন্ধকারে কাটতে পারব না। কত শতাব্দী আমাদের উড্ডয়ন নেই, জমিতে আটকে আছে কালখণ্ড, গবাদিপশুর গন্ধে গৃহের অসুখ মনে পড়ে। একটাই তো নক্ষত্র, তার ভঙ্গুর প্রতিবিম্বগুলি দুলে উঠছে রাতের কলসে। এই তামস বর্তমান প্রতিটি হত্যার পাশে ফুল রাখতে রাখতেই ফেটে যাবে। বীজ রাখো। এছাড়া কিচ্ছু নয় আলোর অধিক। এই বাতাসদশায় মেঘের ভস্ম ওড়ে; ধুলো ভেবে শিশু হাসছে। ঘর হাসছে। চোখ জল সামলাতে পারবে না এরপর। অথচ একে বাঁচাই বা না-বাঁচাই, অন্ধকারে কাটতে পারব না।

 

চোখ নিস্পৃহ নয়। দৃশ্যের আঠায় তার সমস্ত প্রতিভা এঁটে আছে। শিকার দেখতে দেখতে থেঁতো শ্বাসনালীর প্রতি মায়া উঠে আসছে; থামাও! এই তো প্রকৃতি। বাৎসল্য অগ্রাহ্য করতে করতে সন্তানের জন্য অপর সন্তান আনব। ওদের মৈথুন হবে। উলু, শাঁখ হবে। এসব দৃশ্যে আমরা কোথাও নেই। শ্বাসের নাদ শুনে আমরা আকাশের দিকে প্রার্থনা তুললাম। অবতার আসার সময় পরবর্তী কয়েক যুগ নয়, তবু সদ্যোজাত-র দৃশ্যে যেন চোখ শীতল না হয়! এমন সমাধি আজ নির্মিত হয়েছে, যেন অতীতে সন্ন্যাস ছাড়া অন্য কিছু ছিল না কখনও। প্রতিটি পলক যেন সাধনার শেষ নাভিশ্বাস। নতুন পতনে দৃশ্য চোখের আদেশে নিভে যায়।

 

রাত বিশেষণ এসে দেহের সম্মুখে স্থির হল। কেন্দ্র জঙ্গম করে দেবে কে ছড়িয়ে? বৃত্ত তার আয়ু নিয়ে বহুদিন চিতাকাঠ খুঁজছে। বিন্দুর স্থিতি তার এষণায় নুড়ো জ্বেলে দেয়। দেহটি উল্লম্ব, রাত অনুভূমিকএই বৈপরীত্য এতটা সরল নয় একত্রে বসানো। অথচ বসেছে; দিন দেহেরই অধঃক্ষেপ বলে, আজ আর তার কথা নয়। যে-কোনও অনৃত বাক্যে সত্য তার জরায়ু রেখে যায়, দ্যাখো, রাত একটি গুণএই মিথ্যা তবু রাত ঋত করে। দেহ একটি প্রতিক্রিয়া। প্রসারিত হতে হতে অবশেষে গূঢ় বিস্ফোরণ। ছিন্নভিন্ন প্রতি অঙ্গে ঝরে পড়ছে জলের বিভূতি।

 

দুখানা পুতুল ছিল জন্মের জন্য দায়ী। মৃত্যুর মুহূর্তে আমি পুতুল পাব, মা? খেলতে এসেছিলাম সবাই, খেলা বাদে সবকিছু হল। খুনের সংবাদ হল, ত্রাণের ভ্রমণ হল, অথচ যত শরণার্থী আমাদের দুয়ারে বসেছে, তত খাদ্য লঙ্গরখানার পেটে ধরেনি কখনও। তাদের জন্য পুতুল বানাতে বানাতে আমাদের বয়স বাড়বে, মা। তুলো মুখে জড়িয়ে যাচ্ছে, সুতো ছিঁড়ে গেল, তবু খেলব বলে থামেনি সেলাই। মৃত্যুর উনুনে আমি পুতুল পাব, মা? এই এত বৃষ্টি, যেন নৌকাগুলো গিলে নেবে বলে। কাগজের তরী, তাতে হত্যাবিরবণ ভেসে যায়। 

দুখানা পুতুল ছিল খিদের জন্য স্থির। আজ এই দুয়ারে, দ্যাখো, কত মুখ, হাসিমুখ, পুতুলের পেট ছিঁড়ে খায়।

খেলতে এসেছিলাম সবাই, খেলা হল। অন্য কিছু নয়।

 

পরব ফুরোল, আর জেগে গেল নব হাসপাতাল। স্বাস্থ্য নিজে জরা এনে দাঁড়ে রেখেছে। কৃষ্ণনাম বলো, পাখি। কৃষ্ণনাম বলো”... জরা কিন্তু জন্মবোবা, তবু তার নাভি থেকে গাঢ় কৃষ্ণনাম উঠে আসে। পরব এমনই, কোনও শুরু নেই, শেষ আছে যদিও। এর মধ্যে কারা যেন সাপের শঙ্খ লাগা দেখে, দূরের অরণ্যে গেছে মণি পেতে। ছোবল পেয়েছে। তাদের শরীর এল। হাসপাতালে কত মুখ ভয়ে ভয়ে এসে দেখে গেল ছোবলের দাগ। ওদেরই শিশ্নের মাংস মাটির গভীরে পুঁতে জরা ফের কৃষ্ণনাম বলে। হাসপাতাল শেষ, আর জেগে গেল নতুন পরব। বিশাল আগুন ঘিরে গ্রামের মেয়েরা হাসছে, দ্যাখো...

 

উন্মাদিনী ভোরবেলা কুয়োর হাঁ-মুখে নিভে গেছে। ওরও কি বাতাসদশা ছিল? “ধান দে, অলপ্পেয়ে! ধান দে, হারামজাদাবীভৎস গরম মাঠে এক বছর চেঁচিয়ে শুয়ে শুয়ে কাঁদত, দেখেছি। কুয়োয় সবাই যাব। সংসার রাক্ষস লাগে, যেন এই চিরে দিল বুক! অথচ বাতাসদশা এ-তল্লাটে উন্মাদিনী একা নিয়ে নেচে নেচে বেড়াত বিকেলে। কুয়োর তলায় মাঠ ধান দেয়? শয্যা দেয়? কিছুই জানি না। বালতি নামে, জল ওঠে। দড়ি সব বুঝেশুনে চুপ। এ তো আর আত্মহত্যা নয়। প্রতিটি তপস্যা আজও মাটির কুহকে ডুবে শেষ। উন্মাদিনী ভোরবেলা কুয়োর অতলে নিভে গেছে। এত জল নীচে তবু জল দে, অলপ্পেয়েসারারাত বেজে বেজে ওঠে।

 

গৃহের করোটি নিয়ে উপসংহারে নামিয়ে রাখি। আপাতত এটুকু বন্ধক। নতুন ভূমিকা নেই। একটি প্রবাহ গিয়ে অপর প্রবাহে মিশে গেল। বাপ অন্ধ ছিল, আছে, তাই না এত শান্ত চারধার! গৃহের করোটি দেখে নির্ঘাত গলায় দড়ি দিত। বাকি যা হাড়ের স্তূপ, বিকল গুহার পেটে চুপিচুপি রেখে এসে গাছতলায় বসি। সমস্তই খিদের কারণে। ভাতে, সেই জন্মের সময় থেকে আজও, রক্তের সুঘ্রাণ একা পাই। উপসংহার এত ভারী হল, যাত্রাপথ মুচড়ে না যায়! ভ্রমণ ব্যতীত কোনও সমাধান ছিল না ও নেই। ঋতুমতী বোন এসে কাঁধে চাপে, কাঁধ পুণ্যবান। ওর পায়ে কাঁটা দেখি, কাঁটাগুলি মাংস পেয়ে খুশি। বাপ অন্ধ ছিল, আছে, তাই এত শান্ত চারধার। ক্ষত দেখে নির্ঘাত শিরা কেটে অনর্থ ঘটাত। গৃহের করোটি আজ দূর থেকে বিদায় জানায়। 

পথের কাঁকালে তার শুভেচ্ছা গড়িয়ে নেমে আসে।

 

4 comments: