৬
দিগম্বর চমকেই উঠেছিল প্রায়। কে ডাকে এমন দাপটে ?
বারে বারে হাঁক দিচ্ছে। নিবারণ তক্তপোষের ওপরে শুয়ে ঝিমোচ্ছিল, পাশ ফিরে একটু টান
টান হল। দিগম্বর বাইরে এসে দেখল, মাথায় কাপড়ের ফেট্টি, হাতে তেল পালিশ বাদামি
রঙয়ের লাঠি।
আপনি ?
বিশ্বনাথ। হেমেন্দ্রকুমার দেওয়ানের পিয়াদা।
আসেন। বসেন।
তোমাদের দুই ভাইকে কর্তারা তলব করেছেন।
তলব !!! কীসের জন্য ?
সে আমি বলতে পারব না। কর্তারা বলতে পারবেন। আমাকে যা
বলতে বলেছেন তাই বললাম। ভাসা ভাসা শুনে এলাম দেওয়ান কর্তা, চাটুজ্জে কর্তা, সেন
দাসেদের মাতব্বররা থাকবেন। ও হ্যাঁ, বণিক কর্তাও থাকবেন। আমাকে বলল, তোমাদের সংবাদ
দিতে। বাকিটা আমি বলতে পারব না।
দিগম্বর। দিগম্বর, -- নিবারণ উচ্চস্বরে ডাকল।
আসছি।
বাতাসা জল দাও। রূপার পালিতে জল দাও। পিয়াদাই হোক বা, কর্তাবাবুরাই হোক
উঠানে কেউ এলে তিনি অতিথি। প্রথমে তাকে জল বাতাসা দাও। তারপরে রূপার রেকাবিতে
নারকোলের আর তিলের নাড়ু দাও।
দিগম্বর বলল,-- আসেন। বসেন। জলচৌকিতে বসেন। একটু দম
নিয়ে না হয় বিস্তারিত বলবেন। বাড়িতে
এলেন, এই ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। ভাবতেও খারাপ লাগছে।
নিবারণ বলল,-- আপনাকে দেওয়ান কর্তা পাঠিয়েছেন ?
কর্তারা সবাই পাঠিয়েছেন। আমি দেওয়ান বাড়ির পিয়াদা।
দিগম্বর বাতাসা জল নাড়ু আর তালপাতার পাখা এনে বলল,--
ঘরের দুয়ারে এলেন। তলবের নির্দেশের কথা না হয় পরে বলবেন। আগে একটু জল দিয়ে গলা
ভিজিয়ে নেন।
বিশ্বানাথ পিয়াদা, নিবারণ ও দিগম্বরের আপ্যায়নে একটুও
বিস্মিত হল না। সে জানে কর্তাদের পিয়াদা গ্রামে খাতির পায়। আলাদা সম্মান পায়।
বলল,-- কর্তারা আমাকে হুকুম করেছেন, তাই সেই সংবাদ আপনাদের দিতে এলাম।
নিবারণ বলল,-- একটা কথা বলি, আশা করি আপনে কিছু মনে
করবেন না। আপনি নিশ্চয়ই তলব কথার অর্থ জানেন না। তলব কথাটির অর্থের মধ্যে একপ্রকার
কর্তাদের হুকুম আছে। ভালোবেসে বললে, সম্মান জানিয়ে বললেও কর্তারা স্মরণ করলেও
হাজির হয়ে যেতাম। তবুও আপনে যখন এসে বললেন, কর্তাদের জানাবেন আমরা তাদের তলবের
আদেশ অমান্য করেও নিশ্চয়ই হাজির হব।
আমি কি এতশত মানে বুঝি ? যদি বুঝতাম তা হলে কি
পিয়াদাগিরি করতাম ?
তুমি কর্তাদের জানিও দিও, তলব কথাতে আমাদের যথেষ্ট
আপত্তি আছে।
আমি তো কর্তাদের অত কাছে থাকি না। তাদের ফাই ফরমায়েশ
খাটি, আর তাদের মহল বাড়ির পাহারা দেওয়ার কাজ করি। ভাসা ভাসা শুনছিলাম। ঘোষ, মুখুজ্জে, চ্যাটার্জী, সেন,
দাসেদের মাতব্বররা আসবেন। বণিক কর্তা থাকবেন। দেওয়ানদের নাটমন্দ্দেরর চাতালে বৈঠক
বসবে। কর্তারা বলাবলি করছিল, তোমাদের মধ্যে একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে।
এক গাঁয়ে একসাথে থাকলে অভিযোগ ঠোকাঠুকি থাকবেই। কিন্তু
আমরা জানি না, আমাদের বিরুদ্ধে কর্তাদের আর মাতব্বরদের কি কি অভিযোগ।
তোমাদের আপ্যায়নে মুগ্ধ হলাম। দুপুর গড়িয়ে বিকেলের
শুরুতেই যাব। সংবাদ দিও কর্তাদের। সকালে লাঙ্গল তৈয়ারির কাজে ব্যস্ত থাকি। তা ছাড়া
নানান মানুষজন আসে।
দিগম্বর বলল,-- বলে দিও আমরা যাব। আমাদের সঙ্গে সেনের
আড়ার কেশবনন্দন যাবে। ঠিক আছে আমাদের তলবের কারণ ও অপরাধের বিষয় জানতে পারব।
কেন মিছিমিছি প্রখর করছ দিগম্বর ?
একটা কেমন মাতব্ব্রির বাতাসের বদলের ইঙ্গিত পাচ্ছ ?
ওনারা যা বলবেন, যা জিজ্ঞাসা করবেন, আমাদের যথাযথ
উত্তর দেওয়া অবশ্যই কর্তব্য। কারণ আমরা সবাই একসাথে এক তল্লাটে থাকি।
নিবারণ ও দিগম্বর সেগুন গাছের চারাটি নিয়ে দেওয়ানদের
বাড়ির সিংহদুয়ার অতিক্রম করে খাজনা আদায়ের কাছারির সামনে হাজির হল। রসুল ছুটে গিয়ে
হেমেন্দ্রকুমার দেওয়ানকে সংবাদ দিল। দেওয়ান কর্তার ঘন নীল রঙয়ের ফতুয়া উজ্জ্বল
আলোর মধ্যে দাম্ভিক মেঘ হয়ে এল। কে বলবে
হেমেন্দ্রকুমার বাস্তবে একজন দেওয়ান কর্তা। নবাবের খাস মহলে, আরবি
সামিয়ানার মতো জানালার পর্দাগুলি বাতাসে দুলছে। দেওয়ান কর্তা দিগম্বর এবং নিবারণের
দিকে এমন তাকালেন, যেন বলতে চাইলেন,-- অ। এসেছ তা হলে ?
পরস্পর নিবারণ ও দিগম্বর মুখ চাওয়াচায়ি করল।
দেওয়ানকর্তা হাতের ছড়িটি তুলে রসুলকে নির্দেশ করল,--
শস্য গুদামের পাল্লাটি বন্ধ করে দিয়ে আয়। তোমরা দুইজনে এস। লবণ সুপারি হরিতকি গোটা
হলুদ এইসব কিছু সাথে করে এনেছ তো ? সোনার টুকরো বাকি যা সব আয়োজন করে রেখেছে রসুল।
দিগম্বর বলল,-- হ্যাঁ কর্তা। সবই এসেছে। যদি এখন কিছু
আদেশ করেন, সেই আয়োজন আপনের আদেশের অপেক্ষায়।
যেখানে সেগুন গাছের চারা পুতবে, সেই স্থানটি শেষ
প্রহরে ঠিক করে এসেছি।
শেষ প্রহরে কেন ?
এটিই দেওয়ান বাড়ির নিয়ম। বৃক্ষ চারার স্থান নির্বাচন
শেষ প্রহরেই করতে হয়।
পথ নয় মাটির ওপরে শিল্পীর দাগ। বেলঘর যাওয়ার পথের
দিকে। সোজাসুজি গেলে রেলপথের দিকে। মাটির গাদা করে একটি হল্ট করা হচ্ছে। পাথর ডাই
করা হয়েছে। চারদিকে তাকালে শৌখিন আঙ্গিনা মনে হচ্ছে।
কয়েকজন মাঠকর্মী বসে আলোচনা বিশ্রামের অবকাশে চাষের
পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করছিল। রসুল ছুটে গিয়ে বলল,-- সরে যাও, দেওয়ান কর্তা আসছেন।
কর্তার একটু কাজ আছে।
হেমেন্দ্রকুমার বলল,-- সেগুন চারা কোথাকার ?
বেইলি সাহেব দিলেন। বললেন, পাহাড়ি অঞ্চলের।
বেইলি সাহেব। জমি জরিপের কাজ করেন।
এই সমস্ত অঞ্চলের মানচিত্র আঁকার কাজ করছেন।
শুনেছি তুমিও বেইলি সাহেবের কাছারিতে কাজ করো ?
আজ্ঞে। মানচিত্র আঁকার কাজে তাকে সহায়তা করি।
তুমি নক্সা করার কাজ জানো ?
সবই বেইলি সাহেবের আশীর্বাদ।
হেমেন্দ্রকুমার হঠাৎ দুই হাতে নির্দেশের মতো করতালি
দিয়ে উঠল, একজন পড়িমরি করে ছুটে এল সিংহদুয়ার টপকে। -- হুকুম করুন হুজুর।
এক ঝুড়ি কদমা আর চিনির পুতুল নিয়ে আয়। রসুল ভুলে
গেছে।
আজ্ঞে হুজুর।
সেগুন হল সেরা সম্পদ। যত বড় হবে, গাছের কাঠ যত পোক্ত
হবে, সম্পদের বহর ততই বৃদ্ধি হবে। আমার পিতৃদেবের নাম তোমার জানা আছে নিবারণ ?
আজ্ঞে। পূজনীয় খগেন্দ্রনারায়ণ দেওয়ান।
মনে রেখেছ দেখছি। ভেবেছিলাম পিতৃদেবের উপাসনা ঘরের
পাশে প্রতিষ্ঠা করার স্থান স্থির করব। কিন্তু অনুজ রামেন্দ্রকুমার বলল, রেললাইন
দিকে যাওয়ার পথে প্রতিষ্ঠা করতে। ভবিষ্যতে অনেক পথচারী গাছের ছায়া পাবে। জিরিয়ে
শরীর শীতল করে নেবে। কথাটা মন্দ বলে নি। বৃক্ষের শীতল ছায়া আমাদের সনাতন ভাবনায়
আরাম দেয়।
আজ্ঞে। ছোটোকর্তা ঠিক বলেছেন।
দিগম্বর আমার স্টেটের একটা নকশা করে দিও।
বেইলি সাহেব সবটাই করছেন। নিক্তি নিক্তি জমি সবার সবই
নক্সার মধ্যেই থাকছে। সীমানা যদি জবরদখল না হয়, তা হলে জমি চিহ্নিত করার মধ্যে
দীর্ঘশ্বাস পাওয়া যায় না। নক্সা দোষহীন হয়।
হেমেন্দ্রনারায়ণ দিগম্বরের কথা শুনে গম্ভীর হয়ে
বলল,-- বণিক দিঘির ওইপাশে কিছু জমি ছিল, দিঘির পাড়ে শূদ্রদের বসবাস ছিল। আমি সেই
জমি দান করেছি। ওরা ওখানে
বসবাস করে, স্থায়ী জনপদ গড়ে তুলুক। তুমি বেইলি সাহেবকে এই বিষয়টি একবার জানিও।
আমরা যেদিন থাকব না, আমাদের উদারতার ইতিহাসটিকে স্থান দিও দিগম্বর। বেলঘরের আগামী
দিনের মানুষ এই সত্যটি জানুক।
হেমেন্দ্রকুমার বৃক্ষরোপণের কাজে যে পটু, নিবারণ ও
দিগম্বরের বুঝতে অসুবিধা হল না। হরিতকি হলুদের টুকরো সোনার ক্ষুদ্র পাত এমন করে
বাঁধল মনে হতেই পারে একটি গোপন ইচ্ছে হেমেন্দ্রকুমার যত্নে লালন করেছে। কর্তাদের
গোপন ইচ্ছা ও আকাংখাগুলি অনেক সময় বোধে ঠাহর হয় না।
হেমেন্দ্রকুমার দিগম্বর নিবারণের হাতে কদমা চিনির
পুতুল দেখিয়ে বলল,- নাও এই মেঘ আকাশ ও মাঠ পাখি জলাশয়ের মাছ মুখ মিষ্টি করিয়ে
নাও... তোমাদের সাক্ষী রেখে এই সেগুনের নাম রাখলাম... খগেন্দ্রনারায়ণ দেওয়ান।
দিগম্বর ঢোঁক গিলল। হেমেন্দ্রকুমারের দিকে তাকিয়ে ‘থ’
হয়ে গেল। হাতে তার বলদরূপী চিনির পুতুলটি মাটিতে পড়ে ভেঙ্গে গেল।
Darun laglo.
ReplyDeleteবাঃ!!
ReplyDeleteভালো গল্প।
ReplyDelete