প্রাচীন গ্রিসে যে
চিন্তা চেতনার উত্থান হয়েছিল, উত্তর আধুনিক যুগে এসে সেই চিন্তা নিজের ক্ষেত্র
প্রসারণ করে রূপবদল ঘটালো । এখন আর সাহিত্য কিংবা দর্শন আলাদা বিষয় নয় । কোনও শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাকাডেমিক স্তরে হয়ত সাহিত্য, শিল্পকলা ও দর্শনের আলাদা বিভাগীয় বিভাজন আছে, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার বাইরে সমাজ ও রাষ্ট্রে দর্শন কিংবা সাহিত্যের
যে প্রভাব, তার মধ্যে বিশেষ তেমন রূপভেদ নেই । সাহিত্য ও দর্শনকে
আজ বিশ্বপরিস্থিতির অনেক দিক সম্পর্কে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে । লেখা আজ এমন কর্তব্য
যা আপনাকে পালন করতেই হবে নিজেরই দায়বদ্ধতার কারণে । এই পৃথিবীতে মানুষ প্রতিদিনই পরিচিত
হয় তার প্রকৃত কর্তব্যের সঙ্গে । সেই কর্তব্য হল তার বিবেকের কাছে অভিজ্ঞতার আলোচনা
করা ও একরকম করে তার নিজের স্বীকারোক্তি দেওয়া । একজন ব্যক্তিমানুষ যখন কোনও অভিজ্ঞতার
মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, বা চাইছেন তার জীবন তেমনই অভিজ্ঞতার মধ্যে
দিয়েই চলমান হোক, অথচ বাস্তবে ব্যক্তিটি সেই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি
হচ্ছেন না, কিংবা ঘটমান অভিজ্ঞতায় সে তার নিজের স্বরূপ ও ভূমিকাটিকে
খুঁজে পাচ্ছেন না, ফলে সেই ব্যক্তি নিজেই জন্ম দিচ্ছেন নিজেকে
সেই ঘটনার অংশীদার রূপে । এভাবেই একজন লেখক নিজেকে কাহিনির মধ্যে বাঁচিয়ে রাখে । সেই
কাহিনির অংশীদারিত্ব পেতে তাকে বেছে নিতে হয় কোনও একটি চরিত্রকে । আবার এমনও হয় লেখক
তার কাহিনিতে অন্য কোনও মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে চরিত্রের আড়ালে ।
এবার
যদি লেখা কোনও গদ্য বা গল্প না হয়ে, কিংবা উপন্যাস না হয়ে, তা কবিতা হয়, তখনই তার মধ্যে আড়ালের সঙ্গে সঙ্গে
উঠে আসে জটিল অন্ধকারের সত্য । উত্তর আধুনিক দর্শন সামগ্রিকভাবে সাহিত্যের সঙ্গে লেখকের
একটা আত্মজৈবনিক সম্পর্ক স্থাপন করে । সমালোচনার সাহিত্য থেকে লেখা সম্পর্কে আমরা যে
বিশ্লেষণ পাই, সেও আমাদের জীবনের প্রতি এক জিজ্ঞাসা ।
প্রলিফিক
রাইটারদের কথা আমি এ প্রসঙ্গে পরে বলছি । সাহিত্যের একটা বিরাট দিক সাধারণ পাঠকের কাছে
প্রায় পৌঁছয় না বললেই চলে । সাহিত্যের প্রকাশক, ব্যবসাদার, সাহিত্যগোষ্ঠীর কিছু অংশ যারা সত্যিকারের লেখাগুলোকে মানুষের সামনে আসতে
দেয় না । পরিবর্তে তারা দিনের পর দিন প্রকাশ করে চলে গতানুগতিক সাহিত্য যা সাধারণ মানুষ
খুব সহজে গ্রহণ করে । মানুষের এই প্রশ্নবিমুখতার ওপর বিশ্বাস রেখে একশ্রেণির লেখকদের
সারাজীবনের সাহিত্য চলতে থাকে । প্রলিফিলিক রাইটার বলতে এখানে মূলত তারাই ।
বাঙালি
লেখকদের প্রায় অধিকাংশই নিজেদের মজ্জায় এই বিষ বহন করে লিখতে আসে, যে লেখা সংক্রান্ত
সহজ মধ্যবিত্তময় 'সাহিত্যজীবনই' লেখক
হিসাবে পরম সুখের জীবন । প্রতিষ্ঠিত ভারতবর্ষে রিপ্রেসিভ সমাজ সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই
মিথ্যে পুজো দিয়েই পাঠ শুরু করে এবং পরিশেষে অহেতুক কান্না ও সহজ ফিলোজফিতে আশ্রয় নিয়ে
সাহিত্যজীবন শেষ করে । ততদিনে, তৈরি হয়ে গিয়েছে তাঁদের বিশেষ
শ্রেণির পাঠককূল, খ্যাতি, পুরস্কারের
একটা লম্বা তালিকা এবং হাতে পেয়ে গিয়েছেন সস্তা প্রকাশকদের একাংশ, যারা বছরের পর বছর কাগজ খরচ করে একই সমান্তরাল লেখা ছাপার জন্য ।
যদিও
লেখা হল সেই গোপনীয়তার অংশ যেখানে আমরা
নিজেকে লুকোতে পারি না । আবার যার মধ্যে দিয়ে আমরা সম্পূর্ণ ধরা পড়ে যাই, এটাও
চাই না । কিন্তু একজন লেখক তাঁর লেখাতে নিজের গোপনীয়তার সম্পূর্ণটাই ব্যবহার করে ।
চরিত্রের মাধ্যমে, প্লটের দ্বারা, কিংবা পংক্তির অাড়ালে একজন লেখক বা কবি যে
অরণ্য রচনা করে, তা তাঁর নিজের জন্য যেমন চিরকাল একটা আড়াল হয়ে থাকে, তেমনই তাঁকে
জানতে চাইছে যে পাঠক, তার জন্য খুলে দেয় অনুসন্ধানের একটা রাস্তা । লেখা তাই
সর্বদা চায় প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক থেকে মুক্তি পেতে । সম্পর্ককে নিজের মতো করে
লেখক তাঁর লেখায় ব্যবহার করে, করে প্রেমকে একটা স্বাধীনতার জায়গা এনে দিতে । লেখক
চায়, তাঁর নিজের ভিতরে যে সত্য পড়ে আছে, লেখায় তা বেরিয়ে আসুক, অথচ সেই সত্যের
সামনে সর্বদা একটি আড়াল থাক, যাতে মানুষ নিজের প্রয়োজনে সেটা খুঁজে নিতে পারে ।
অদ্ভুত শুনতে লাগবে, তবু এইসব প্রতারণার মাধ্যমে
লেখার সঙ্গে একজন লেখকের সারাজীবন কাটে । এই স্বচ্ছতার সঙ্গে নিজেকে প্রতিস্থাপিত করতে
পারাটা একটা ভীষণ কঠিন কাজ । মানুষ চিরকাল ছোটে অসম্ভবের পিছনে, যতদিন সে পেতে থাকে
ততদিন সে কী হারাল তার খোঁজ সে রাখে না । এ নিয়ে একজন লেখকের কোনও অপরাধবোধ নেই । নিষ্ঠুরতা
তাঁকে মমত্ববোধের শিক্ষা দিয়েছে, এবং মমতাই তাঁকে নিষ্ঠুরতার দিকে ঠেলে দিয়েছে ।
সমস্যা হল, সাহিত্যের
ইতিহাস থেকে তারিখ, সাল সমেত যেসব ঘটনাগুলোকে নেওয়া হয়ে থাকে,
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিন্তু বাদ দেওয়া হয় সেই ঘটনার পিছনে থাকা কারণ
ও তাৎপর্যগুলিকে । সেইসব গদ্যের সবচেয়ে মর্মান্তিক ভুল (এটা
অবশ্য লেখকের ভুল নয়, লেখক এই ভুলের শিকার, কেননা বাংলা সাহিত্যে অধ্যাপনা ও গবেষণার কাজে নিযুক্ত মানুষেরা বহুদিন
ধরেই এই ভুলকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে পাঠকের সমাদর পাওয়ার জন্য । কিন্তু যে অংশের ভুল
এটি, সেই অংশের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ও বিশ্ব সাহিত্যের
ইতিহাসকে পাশাপাশি রাখলে পাঠকের মোহভঙ্গ হবে )হল অঘোষিতভাবে
প্রথাগত সামাজিকতার দাসত্ব করা। যেমন, হাংরি আন্দোলনকে গিন্সবার্গের প্রতিষ্ঠান
বিরোধিতার সঙ্গে এক করে দেওয়া । কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য বলে, গিন্সবার্গ মার্কিনদের বিট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যা হাংরি আন্দোলের
চেয়ে একেবারে আলাদা । প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ক্ষেত্রে হাংরি, অ্যাংগ্রি কিংবা বিট আন্দোলনের ম্যানিফেস্টো, বুলেটিন
কিংবা টেক্সটগুলোকে যদি একই সরলেরেখার অংশ বলে কোনও সাহিত্যিকরা তাঁদের প্রবন্ধে চালানোর
চেষ্টা করে, তা হলে বলতে হবে তাঁদের চিন্তাধারার প্রধান অন্তরায়
হিসাবে কাজ করেছে সীমিত পাঠপরিসরের বিশেষজ্ঞতা, অর্থাৎ কেবল
বাংলা ভাষাসাহিত্যের পঠনপাঠন, বিশ্বসাহিত্যের নয় । যার দরুণ
'লিটারাল মাল্টিডিসিপ্লিনারি অ্যাপ্রোচ' সম্ভব হয়নি তাঁদের পক্ষে। তাঁরা এক্ষেত্রে ব্যক্তিমানুষের জীবনকে সাহিত্যের
উপকরণ হিসাবে প্রয়োগ করে কবিদের অবস্থানকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন, ফলে কৌমসমাজের পক্ষপাততুষ্টতা সেই সকল প্রলিফিক রাইটারদের লেখায় রয়ে গেছে
এবং তা দশকের প্রতিস্ব নির্মাণে ব্যর্থ হয়েছে । 'স্বীকারোক্তিমূলক' কবিতার উৎসসন্ধান,
সাংস্কৃতিক প্রয়োজনীয়তা, ইউটোপিয়াগুলোর সম্পর্কে
পাঠকে সচরাচর জানানো হয় না তাঁদের লেখায়, কেবল বলা হয় এর অবস্থান কিছু কিছু
নির্দিষ্ট দশকে । পাঠককে সম্পূর্ণ অবগত রাখা হয় এ ব্যাপারে। 'স্বীকারোক্তিমূলক' কবিতা বা
Confessional poetry-এর জন্ম বিশ্বসাহিত্যে মার্কিন কবি সিলভিয়া
প্লাথের হাত ধরে । '৫৬ সালের খাদ্য সংকট, '৬৬ সালের খাদ্য আন্দোলনের
সঙ্গে কৌশলগত ভুল বার্তা যে প্রচলিত পত্রিকাগুলোতে দেওয়া হয়েছে তা একপ্রকার নিন্দনীয়ই
বলতে গেলে । দেখানো হয়েছে যে সেই সময়ের ফ্রান্স, চেকোস্লোভিয়াতে
যে ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার একাংশের ভিত্তিছিল বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা ও খাদ্যআন্দোলনগুলি
। ফ্রান্স ও চেকোস্লোভিয়ার এই আন্দোলনের সঙ্গে দেশীয়ন খাদ্য সংকট ও আন্দোলনের বিপুল
ঐতিহাসিক পার্থক্য ছিল, বেশিরভাগ লেখক নিজেদের সুবিধার্থে
সেই সামাজিক চিত্র ও রাজনৈতিক সত্যকে তুলেই ধরেনি, কারণ তাঁদের
কলম সরকারের ঘোষিত নীতির সমালোচনার পথ কখনও গ্রহণ করেনি । সেই সময়কার সাহিত্যে উল্লেখ
নেই চিত্রপরিচালক জাঁ লুক গোদার ও দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রের সাংস্কৃতিক সর্বভৌমত্বের
কথা, যা ছাত্র আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল । একইভাবে
দশকগুলোর ব্যাখ্যায় ভিয়েতনামের যুদ্ধ (মার্কিন ও চীন বিরোধিতার
দুটি স্লট), রবার্ট কেনেডি হত্যা, বলিভিয়ায় চে'র মৃত্যু এই তিনটি পৃথক ঘটনাকে কৌশলে
জুড়ে দেওয়া হয়েছে । বিশ্লেষণ করা হয়নি, করলে বোঝা যেত তিনটি
ঘটনার পৃথক প্লট কতটা আলাদা ।
বাঙালি
লেখকেরা(এ যাবৎ কালের লেখকেরা পর্যন্ত) ভিয়েতনাম যুদ্ধকে
ষাটের দশকেই দেখিয়েছেন, যেখানে সত্যিটা হল এই যুদ্ধ চলেছিল সত্তরের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। পশ্চিমবঙ্গে
১৯৬৭, ১৯৬৯ এর সময়ে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে নকশাল আন্দোলনের
প্রভাবটিও লেখকরা কথার মালা দিয়ে সাজিয়ে গিয়েছেন, গভীরে যাননি।
বাঙালির লেখালিখিতে নেই বিশ্বসাহিত্যে ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে লিটারাল মুভমেন্টগুলোর
কথা । ওয়ারশ চুক্তির বিরোধিতায় পূর্ব জার্মানি, হাঙ্গেরি,
পোল্যাণ্ড, সোভিয়েত, আলবেনিয়া, চেকরিপাব্লিকের কবিদের লিটারাল মুভমেন্টের
কথা। নেই নিও-ইকোনমিকাল অর্থনীতিতে কবিদের মুভমেন্ট ও সাংস্কৃতিক
লড়াইয়ের কথা। আজ সামগ্রিকভাবে শূন্য দশকে
ও প্রথম দশকের সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদদের ওপর এই অতিরিক্ত দায়িত্ব এসে পড়েছে যে তারা
কথা বলুক, আলোচনা করুক, জাতির এই
দৃষ্টিভঙ্গি ও সাহিত্যের এই ফাঁকগুলোকে নিয়ে, অন্ততপক্ষে জীবনের
সুদীর্ঘতম বিবেকের কারাগারে অস্পষ্টতম অন্ধকারে আত্মার গোঙানি ও গর্জন যদি এঁরা সত্যিই
শুনে থাকে নিজেদের কানে! সম্ভাবনাময় দর্শন, চিন্তা,
চেতনা যদি সত্যনিষ্ট হতে গিয়ে কালচে হয়, তবে সেজন্য চিন্তাবিদদের দোষ দিয়ে কিংবা কোণঠাসা করে কাজ নেই । জীবনের এইসব
দ্বন্দ্ব, এই অভিপ্রায়, আগে থাকতে
কি লুকিয়ে ছিল না আমাদেরই জীবনের মধ্যে? ঠিক যেভাবে বিপুল
আগুনের জন্য দায়ী একটুকরো ফুলকি আগে থাকতে লুকিয়ে থাকে পাথরের মধ্যে!
No comments:
Post a Comment