এলিজি
(১)
“এই তিন বছরে তোমাকে
অনেক জ্বালিয়েছি। আমার সব বায়না তুমি বরাবর হাসি মুখে মেনে নিয়েছ, সব সময় আমাকে ছোটবোনের
মতো আগলে রেখেছ। তাই আজ বড় একটা আবদার করছি। আমাদের দুই বাড়ি আজ একসাথে বসে বিয়ের
কথাটা পাকা করে ফেলল। ব্যাপারটা সামনের ফ্রেব্রুয়ারিতেই হয়ে যাবে। তার আগে আমি চাই
তোমার আর সুমিতের একবার দেখা হোক। জানি ওই ঘটনা নিয়ে তোমার মনেও কিছু প্রশ্ন আছে। আমি চাই সুমিত যেভাবে
আমার ফ্যামিলির সঙ্গে বসে ব্যাপারটা ম্যানেজ করে নিয়েছে তোমার সাথেও ঠিক সেটাই করুক।
যদি রাজি থাকো তাহলে
রবিবার সন্ধেবেলাটা ফ্রি রেখো। ওকে সিটিসেন্টার-ওয়ানের পিছনের সিসিডিটায় আসতে বলেছি।”
ঘুমভাঙা-আঠালাগা চোখে নবমিতার মেসেজগুলো পড়লাম। একবার, দু’বার, বহুবার। তারপর মালবিকাকে দেখালাম, নিজে থেকেই। ও আমার ফোনে হাত-টাত দেয় না। বরং আমিই
করতাম এইসব। ওর কোনও ছেলেবন্ধুর
মেসেজ দেখলেই রাগারাগি করতাম। স্ক্রিনশট
নিয়ে নিজেকে পাঠিয়ে রাখতাম। এক-একদিন দুপুরে অফিস থেকে হুট করে বাড়ি চলে আসতাম। কিন্তু ফ্ল্যাটে ঢোকার আগে দরজায় কান লাগিয়ে অনেকক্ষণ
দাঁড়িয়ে থাকতাম, কোনও অপরিচিত কণ্ঠস্বরের
আশায়। মালবিকা বুঝত না। অশান্তি হত খুব। ও কিছুতেই বুঝতে পারত না যে আমি যাকে ভালোবাসি তার জীবনে
একমাত্র হতে চাই। চাই তার ধ্যান-জ্ঞান হতে, চাই আমাকে কেন্দ্র
করেই আবর্তিত হোক তার জীবন। তার মানে
কি আমি নিজেকে বিশাল এক কেউকেটা মনে করি? মোটেই না। দেখতে-শুনতে আমি বরাবরই অতিসাধারণ। আর এখন তো একটানা অনেকদিন খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম হওয়ায় সম্ভবত আমার লিভারে কোনও
সমস্যা হয়েছে। চেহারাটা দিন-দিন পাকিয়ে যাচ্ছে, চামড়ায় কেমন জৌলুসহীন হলদেটে ভাব। বংশপরিচয়? না সেখানেও গর্ব করার মতো কিচ্ছু নেই। লেখাপড়ায় ছিলাম কখনও মাঝারি, কখনও তার থেকে সামান্য ভালো। যে চাকরিটা করি সেইরকম কাজ এ-দেশে লাখ-লাখ লোকে করে। খুব ভালো করেই জানি অফিস-ফ্লোরের বাইরে আমাকে কেউ চিনবে না। আসলে আমি সেইরকম এক মাঝারি যারা রাস্তাঘাটে ক্রমাগত অটোওয়ালার
ধাতানি, কন্ডাকটরের চোখরাঙানি,
ট্যাক্সিওয়ালার অবজ্ঞা মুখ বুজে গিলে ঘরে ফিরে আসে। কিন্তু আমার এই চাওয়াটুকু— সেটাও কি একান্তভাবেই মাঝারিমানের
নয়? সেটুকু বুঝতে মালবিকার এত আপত্তি!
কিন্তু এখন হয়তো মালবিকা বোঝে। তাই আর
কিছুই বলে না। শুধুই হাসে। নবমিতার কথাগুলো পড়ে যেমন হাসল।
আজ শনিবার। তাই জেগে উঠেও অনেকক্ষণ
বিছানায় পড়ে রইলাম, যেন সাপের ছেড়ে যাওয়া
কোনও খোলস, নবমিতাকে ভাবলাম। টানাটানা চোখ দুটো কাজল দিয়ে কেমন আরও টানাটানা করে রাখে! ওর পাঁচ ফুট সাতের ছিপছিপে শরীর, মুখখানি ছোট্ট, যেন শ্যামলিমায় মাখা। নানান ধরনের চুলবাঁধার কায়দার মধ্যে কোনটায় ওকে সবচাইতে
ভালো লাগে ভাবতে চেষ্টা করলাম… শেষে
মনে হল মাঝখানে সিঁতে করে চুল খোলা রাখলেই সব থেকে মিষ্টি লাগে। ক্ষিদে পেলে ওর মুখে ঠান্ডা একটা গন্ধ হয়— অনুভবে ফিরে
এল। ওর ডাকনামটা… এসবকিছুর মাঝে জড়িয়ে গেল ওর লেখা কথা ক’টা। টের পেলাম বুকের ফাটলটা
ইদানীং বড় চওড়া হয়ে গেছে। নিঃশব্দেই।
অথচ এমন যে হতে চলেছে তা তো জানাই ছিল।
নবমিতা। সেই বাচ্চা মেয়েটা যাকে
আস্তে আস্তে গড়ে তুলেছিলাম। বছর তিনেক
আগে যখন জয়েন করেছিল, ছিল একতাল ভেজা মাটির
মতো, প্রতিটা ফ্রেশার যেমন থাকে। সম্বল বলতে শুধু শেখার আগ্রহ। কিন্তু ওর সমস্যা ছিল দুর্বল স্মৃতিশক্তি আর অদ্ভুত এক
মানসিক ছটফটানি। সবকিছুতে তাড়াহুড়ো করার
অভ্যাস। সেখান থেকে প্রথমে মেন্টর, পরে টিমলিডার হিসেবে কখনও ভালোভাবে,
কখনও রীতিমতো বকাঝকা করে প্রসেস নলেজ, ইন্ডাস্ট্রি
নলেজ থেকে শুরু করে বিজনেস-স্পেসিফিক অ্যাপ্লিকেশনস সবেতে তুখোড়
বানিয়ে টিম তথা কোম্পানির অন্যতম ভ্যালুয়েবল এমপ্লয়িতে পরিণত করি। যার ফলশ্রুতি বছরখানেক আগে ওর প্রোমোশন। কিন্তু এসব করতে করতে ওর মায়া যে কখন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে
ফেলল, বুঝতেই পারিনি!
বুঝতে পারলাম, যখন প্রোমোশনের ঠিক
পরেপরেই ও আমাকে সুমিতের কথা বলল। আমি অবাক হলাম। ওর কথা
শুনে নয়, নিজের আবদার দেখে। কী অনায়াসে আমি মেনে নিয়েছিলাম আমিই নবমিতার জীবনের ধ্রুবতারা। আমি— যে
কিনা তখনই বছর চারেকের বিবাহিত, প্রতি সপ্তাহে-দু’সপ্তাহে একবার স্ত্রীয়ের সঙ্গে শরীর বিনিময় করে। কিন্তু আমি ছাড়া ওর জীবনে অন্য কেউ কীভাবে প্রাধান্য পেতে
পারে!
আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ খেতাম, সন্ধেবেলা
হালকা জলখাবার খেয়ে ইকোস্পেসের বিশাল ক্যাম্পাসে হেঁটে বেড়াতাম। রাতে বাড়ি ফিরে আবার ওয়াটসঅ্যাপে কথা হত। অফিসে আমাদের নিয়ে কানাঘুষো শুরু হয়েছে, কানে আসত। আমার সমবয়সি ম্যানেজাররা সু্যোগ পেলেই হালকা আওয়াজ দিতে
ছাড়ত না, কিন্তু যেহেতু আমি
এদের বেশিরভাগের সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ দূরত্ব বজায় রেখে চলতাম, তাই কেউ বেশি বাড়াবাড়ি করার সু্যোগ পায়নি। যাই হোক, এভাবেই আগেভাগে ও আমাকে বলেছিল, সুমিত আসলে সুমিত জয়সওয়াল। পেশায় সিএ, নিজস্ব ফার্ম আছে। নবমিতার
একটা কলেজের বন্ধুর ‘সাংগীত’-এ ওর
সঙ্গে আলাপ। সেখানে হালকা ফ্লার্টিং
এবং ফোননম্বর বিনিময়। তারপর নিয়ম
মেনে দ্বিতীয় ধাপের চ্যাটিং পেরিয়ে তৃতীয় ধাপে ডেটিং। অতঃপর দু’জনের দু’জনকে ভালো লেগে যাওয়া। ঠিক যেন একটা ফালতু হিন্দি সিনেমা। হ্যাঁ, ভীষণ রাগ হয়েছিল আমার। ঠিক মালবিকার
ওপর যেমন রাগ হত যখন দেখতাম ও কোনও ছেলের সঙ্গে কথা বলছে। তফাত এটুকুই যে নবমিতাকে আমার রাগের আঁচ পেতে দিইনি। নিজেই
পুড়েছি ক্রমাগত। ও অনর্গল বলে গেছে সুমিতের
কথা, আমি বেশিরভাগ সময়ই চুপ করে শুনে গেছি—
মাঝেমাঝে কয়েকটা মন্তব্য করা ছাড়া— নিজের সঙ্গে
যুঝে গেছি রাগটা নিজের ভিতরেই দমিয়ে রাখতে। লুকিয়ে রাখতে হঠাৎ করে পেয়ে বসা এক ভয়…
ওকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার ভয়।
নবমিতা ততদিনে ওর মা-বাবা, দিদি-জামাইবাবুর সঙ্গে সুমিতের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। অবাঙালির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠা নিয়ে ওর বাড়ি থেকে প্রথমটায়
কোনও আপত্তি ছিল না, কিন্তু গোল বাধল অন্যভাবে। মাস আষ্টেক আগে সুমিতদের পৈতৃক সিএ ফার্ম থেকে ‘অফিস অ্যাসিস্টেন্ট’
লাগবে বলে সব ক’টা প্রথম সারির বাংলা
ও ইংরেজি কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। শর্ত একটাই— আবেদনকারীকে হিন্দিভাষী হতে হবে। বাংলা ও বাঙালির স্বার্থরক্ষার জন্য কাজ করা একটি সংগঠনের
নজরে আসে সেই বিজ্ঞাপন এবং সেই সংগঠনের কয়েকজন সদস্য প্রথম সোশ্যাল মিডিয়ায় ও পরে সুমিতদের
অফিসে গিয়ে সেই বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানায়। সুমিতের বাবা ও জ্যাঠা তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেন এই ফার্মের
অধিকাংশ গ্রাহকই হিন্দিভাষী, তাই
সাবলীলভাবে হিন্দিতে কথা বলতে পারাটা এ-চাকরির জন্য দরকারি বই-কি!
কিন্তু সংগঠনের লোকজন সেই যুক্তি শুনতে নারাজ। তাদের একটাই দাবি বিজ্ঞাপনটি
প্রত্যাহার করতে হবে এবং নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে আর-একটা বিজ্ঞাপন দিতে হবে। চাপের মুখে সুমিতের বাবা ও জ্যাঠা তাতে রাজি হয়ে যান।
সুমিত প্রথমটায় অফিসে ছিল না। এক কর্মচারির
ফোন পেয়ে ছুটে আসে, কিন্তু ততক্ষণে তার
বাবা-জ্যাঠা পিছু হটে গিয়েছে। ব্যাপারটা সুমিত হয়তো একটু ব্যক্তিগত পরাজয়ের পর্যায়ে
নিয়ে ফেলেছিল। এতক্ষণ ওর গুরুজনেরা
যে ভুলটা করেননি ও সেটাই করে বসে। মেজাজ হারিয়ে
ও সংগঠনের লোকেদের দিকে তেড়ে যায়, প্রথমে
তাদের ও পরে ‘বাংগালি জাত’-কে গালাগালি দিতে থাকে। সদস্যরা অবশ্য প্রত্যুত্তরে একটাও কটু কথা বলেনি। তারা
‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে সেখানে থেকে বেরিয়ে যায়। ওদের একজন গোটা ঘটনাটার ফেসবুক লাইভ করছিল। তাই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সুমিতের বাঙালিদের খিস্তি করার
ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়ে। তবে যেহেতু রাজ্যের
নাম পশ্চিমবঙ্গ আর যাদের গালাগালি দেওয়া হয়েছে তারা বাঙালি, তাই সেই ভিডিও তেমন ঝড় তোলেনি। তাছাড়া ঘটনার একদিন পরেই সুমিতদের ফার্মের তরফ থেকে সত্যিই
ক্ষমা চেয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। বলা হয় আগের বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার করা হল— যে কেউ এখন ওই পদের জন্য আবেদন করতে পারে।
কিন্তু এবার প্রশ্ন ওঠে নবমিতার বাড়িতে। ভিডিয়োটা ওদের চোখে পড়ার পর স্বভাবতই তারা সন্দেহপ্রকাশ করে।
এতটা বাঙালিবিদ্বেষী যে ছেলে, তার সঙ্গে একটা বাঙালি মেয়ের সম্পর্ক কি আদৌ স্থায়ী হবে!
এই একই প্রশ্ন আমিও ওকে করেছিলাম, একটু ঘুরিয়ে— ‘তোর ওকে জিগ্যেস করা উচিত ছিল কথাগুলো
বলার সময় তোর কথা ওর একবারের জন্যও মনে পড়েছিল কিনা। রাগের কথা কিন্তু অনেকসময় মনের কথা হয়। তুই আমার নিজের বোন হলে আমি জোর খাটিয়ে এইরকম একটা ছেলের
থেকে তোকে সরিয়ে আনতাম।’
নবমিতা সেদিন কোনও উত্তর দেয়নি। তারপর থেকে
ও আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। অথচ ফেসবুকে
দেখতাম শনি-রোববার করে নানান ক্যাফে-রেস্টুরেন্টে ও সুমিতের সঙ্গে দেখা করছে। আমি যেচে কিছু জিগ্যেস করতাম না, শুধুই পুড়তাম। খুব চেষ্টা করতাম ওর ওপর রাগ করার, ভাবতে চেষ্টা করতাম কতটা নির্লজ্জ হলে এখনও
এমন একজন ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। তা সত্ত্বেও রাতবিরেতে ওয়াটসঅ্যাপ খুলে ওর অনলাইন স্ট্যাটাসটার
দিকে হাঁদার মতো চেয়ে থাকতাম। ওপাশে জেগে
রয়েছে ও, অথচ আজ আর ওর প্রয়োজন
নেই আমি রাতে খেয়েছি কিনা সেকথা জানার। বুকে ফাটল ধরে। অফিসেও আমাদের কথাবার্তা কমে আসছিল। শুধুই কাজের কথা। তাও সীমিত।
কারণ এখন ও একা-একাই নিজের ডেলিভারেবলস
সামলে নিতে পারে। আমার সঙ্গে
লাঞ্চে যেত না। সন্ধেবেলা হাঁটতেও বেরোত না আর। যত বুঝতে পারছিলাম সপ্তাহে পাঁচ দিন, দিনে ন’ ঘন্টা ওর চোখে
সামনে থেকেও ওর জীবন থেকে আমি আস্তে আস্তে বাষ্পীভূত হয়ে যাচ্ছি, ততই চওড়া হচ্ছিল বুকের ফাটলটা।
এভাবেই চলতে চলতে হঠাৎ আজ এইরকম একটা মেসেজ।
তাহলে এই জন্য গত দু’দিন ছুটি নিয়েছিলি,
নবমিতা!
শনিবার সারাটা দিন বড় এলোমেলো কাটল। ভেবেছিলাম ভিতরের আমিও বেশ শান্তভাবেই মেনে নিয়েছে গোটা ঘটনা।
রৌদ্রোজ্জ্বল নীল আকাশের নীচের প্রশান্ত বঙ্গোপসাগর যেন। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে সন্ধে নামতে না নামতেই সেখানে
সাইক্লোনের পূর্বাভাস দেখা গেল। রবিবার
সকালে সেটা রীতিমত ফুঁসে উঠল আর বিকেলের আগে ভয়াবহ রূপ নিল।
মালবিকা আজকাল আবার আমার মুখ দেখলেই সব বুঝতে পারে। বুনো সাইক্লোনটাকে হালকা নীল জ্যাকেটের আড়ালে লুকিয়ে যখন
বেরোতে যাচ্ছি ওর সঙ্গে চোখাচুখি হতেই ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসল। আমি চট করে চোখ সরিয়ে নিলাম।
দরজায় তালা দিচ্ছি। এমন সময় নবমিতাকে হারিয়ে ফেলার সেই ভয়টা হঠাৎ ফণা তুলে আরও
একবার ছোবল মারল। আমি কেঁপে উঠলাম।
(২)
—‘সুমিত, এই হল সন্ময়দা, আমার ফ্রেন্ড, ফিলোজফার
অ্যান্ড গাইড,’ নবমিতা হাসি হাসি মুখে শুরু করল, ‘ফার্স্ট জবেই এমন একজন ম্যানেজার পাওয়াটা ইস পিওর—’
—‘নো ডাউট! আমি কিন্তু আপনার ব্যাপারে স-ব জানি সানমোয়দা, তাই আমিও আপনাকে ‘সানমোয়-দা’ ডাকছি, ওকে?’
আমার সমস্ত মনোযোগ এতক্ষণ শুধুই নবমিতার দিকে ছিল। একটা চারকোনা টেবিলের দু’দিকে সুমিত আর আমি মুখোমুখি বসেছিলাম,
আর ও ছিল আমার ডানদিকে, ত্রিভুজের শীর্ষবিন্দু
হয়ে। এসে থেকেই আমি ওর মুখের
ভাব দেখে বুঝতে চেষ্টা করছিলাম ঠিক কী ভেবে ও আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে। সচরাচর আমি ওর মুখ দেখে মনের ভাষা পড়তে পারি। কিন্তু আজ
কোনও কারণে সেটা পেরে উঠছিলাম না বলে অস্বস্তি হচ্ছিল। এমন সময় কানে এল এক অমায়িক ভঙ্গিতে কেটে কেটে বলা সুমিতের
এই বাংলা কথা ক’টা। আমার অভ্যস্ত কান অনায়াসেই চিনতে পারল ওর কণ্ঠস্বরের কৃত্রিমতা। তাছাড়া সেই ভিডিয়োটাও আমার দেখা ছিল যেখানে ও বাংলাই বলছিল
কিন্তু স্বর ছিল অন্য গ্রামে বাঁধা। কিন্তু তা-ও মুগ্ধ হতে বাধল না।
—‘আমিও তোমার সম্পর্কে অনেক শুনেছি।’
অমায়িক স্বর যে পাতলা ঠোঁট দুটো থেকে ঝরে পড়ছিল, সেখানে এতক্ষণ ঝুলে ছিল ব্যবসাদার মার্কা অমায়িক হাসি। আমার উত্তর শুনে এক মুহূর্তের জন্য হলেও সেটা মিলিয়ে গিয়ে
ফিরে এল। বুঝলাম, আপনির জবাবে ও আপনি আশা করেছিল। ছেলেটার মুখেও একধরনের নিটোল ব্রণহীন, গোঁফদাড়িহীন কৃত্রিমতা আছে, নবমিতার ফেসবুক পোস্টের দৌলতে অনেক আগেই সেটা লক্ষ করেছি। অমায়িক এই হাসিটা সেই কৃত্রিমতাকে কয়েক ওয়াট বাড়িয়ে তোলে
যেন। আমার ইচ্ছে হল হাসিটা
আর-একবার নিভিয়ে দেখি ওকে আসলে কেমন দেখতে।
—‘নিশ্চয়ই খারাপ চিজই শুনেছেন। হেঃ হেঃ হেঃ। এনি ওয়েজ
তাহলে আর ইন্ট্রো লাগছে না। বলেন কী
খাবেন?... অ্যাকটুয়ালি এই
মিটিং-টা নিয়ে আমি একটু টেনশনে আছি। আপনার অ্যাপ্রুভালের ওপর অনেক কিছু ডিপেন্ড করছে, ইউ নো! কী রাই,
ঠিক বললাম তো?’ কথাগুলো বলে ও নবমিতার দিকে চেয়ে
বাঁ-চোখ টিপল।
‘রাই’ নবমিতার ডাকনাম। আমার বরাবরই
মনে হয় ওর ভালোনামের থেকে ‘রাই’ নামেই ওকে বেশি মানায়। আমার বড় ইচ্ছে করে ওকে ‘রাই’ বলে ডাকতে। কিন্তু কখনও ডাকতে পারিনি। অথচ এ কী অবলীলায় ডেকে ফেলল!
সেই তিক্ততা থেকেই বললাম, ‘হাঃ!
আমার আবার অ্যাপ্রুভাল! কী যে বলো! তোমাদের লাইফ, তোমাদের ডিসি—’ কিন্তু
নবমিতার দিকে চোখ পড়তেই দেখি ও কেমন আহত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমার দিকে। হয়তো আমার চাপা
বিরক্তিটা ওর কাছে ধরা পড়েছে। আমি থেমে
গেলাম ওকে ওর কথা বলার সু্যোগ করে দেওয়ার জন্য।
ও বলতে শুরু করল, ‘সুমিত ঠাট্টার ছলে
বললেও বাড়িয়ে বলেনি। তোমার মতামত
আমার… আমাদের কাছে কতখানি ইমপরট্যান্ট সেটা
হয়তো তুমি বুঝতে পারছ না। ঠিক অ্যাপ্রুভাল
না হলেও আমিই চেয়েছিলাম—’
—‘ওঃ সানমোয়দা, অনলি ইফ ইউ নিউ,’ এই নিয়ে পরপর দু’বার নবমিতার কথা কেটে সুমিত বলে উঠল,
‘এক্সপ্লেনেশন দিয়ে দিয়েই আমার দিন কাটছে আজকাল। রাগের মাথায় একটা… স্লিপ অফ টাং…’
সুমিতের শেষ কথাটা আমাকে বাধ্য করল নবমিতার চোখের দিকে তাকাতে। তাকিয়ে দেখি ও আগে থেকেই আমার দিকে দেখছে। আর তখনই এই প্রথমবার আমার মনে হল ওর মন পড়তে পারলাম। ওর চোখে স্পষ্টতই ছিল সুমিতকে নিয়ে আমাদের শেষ কথোপকথনের
আভাস। তার সাথে আরও কিছু, ঠিক যা যা এতক্ষণ পড়তে চাইছিলাম। আমি ভরসা পেলাম। টেবিলে ভর দিয়ে বুকের সাইক্লোনটার অস্তিত্ব আর একবার অনুভব
করে বললাম, ‘স্লিপ অফ টাং!
ইন্টারেস্টিং! তাহলে তো শুনতে হচ্ছে… তোমার এক্সপ্লেনেশন!’
ওয়েটার এসে অর্ডার নিয়ে যাওয়ার পর সুমিত শুরু করল, ‘আপনি তো সবই জানেন। ওর পেরেন্টসকে যেটা বলেছি আপনাকেও সেটাই বলছি। ওরা যখন আমাদের অফিসে অ্যাটাক করেছিল আই ওয়াস্ন’ট দেয়ার। খবর পেয়ে গিয়ে দেখি দোস গুনস আর থ্রেটেনিং মাই ফাদার অ্যান্ড
আংকল। আর আপনারা কী যেন বলেন
ভয়ে জড়… জড়…’ নবমিতা পাশ থেকে বলল ‘জড়োসড়’— ‘ইয়েস, দ্যাট হয়ে আছে। দুটো সিনিয়র
সিটিজেন, ক্যান ইউ ইমাজিন?
এবার আপনিই বলেন এসব দেখে কাঁহাতক মাথা ঠান্ডা…’
—‘তুমি যাদের গুনস বলছ তারা কেউ ইউনিভার্সিটির ছাত্র, কেউ
বা ভালো চাকরি করে। সে যাই
হোক, তা ওর পেরেন্টস তোমাকে জিগ্যেস করেনি
যে, নিজের বাবা-কাকাকে অসহায় অবস্থায় দেখে
রাগ হওয়ার ব্যাপারটা না হয় মানা গেল, কিন্তু জাত তুলে গালাগালি
করার মধ্যে কোন ক্রসেড ছিল?’ ওকে মাঝপথে থামিয়ে জিগ্যেস করলাম।
—‘আরে ওরাই ‘বাংগালি-বাংগালি’ বলে চিল্লাচ্ছিল। তাই—’
—‘বুঝলাম। আচ্ছা তুমি
কি মনে করো ওইরকম একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে তোমরা ঠিক করেছিলে?’
—‘হ্যাঁ। হানড্রেড
পারসেন্ট। যে জবের জন্য যেমন স্কিলসেট
লাগে সেটা লিখে অ্যাড দেওয়া অন্যায় কীসের?’
—‘কিন্তু এই ব্যাপারটা তো শুধুই স্কিলসেটে সীমাবদ্ধ থাকছে না, এটা অসাংবিধানিকও বটে। ‘অসাংবিধানিক’
মানে বুঝতে পারছ তো? তাছাড়া রাজস্থানে গিয়ে
যদি কোনও বাঙালি ব্যবসায়ী বিজ্ঞাপন দিয়ে বলে শুধুই বাঙালিদের চাকরি দেবে, তখন তোমাদের কেমন লাগবে?’
সুমিত একটু থমকাল। মনে মনে
কথা সাজিয়ে নেবার জন্যই বোধহয় একটু সময় নিল, তারপর বলল, ‘বুঝতে পারছি আপনি আমাকে গ্রিল করছেন। এটা কি রাইয়ের প্ল্যান?’ বলে আবার নবমিতার দিকে তাকাল। যদিও এবার আর হাসল না বা চোখ টিপল
না, ‘আমি কিন্তু বাঙালিদের অনেক সন্মান
করি।’
—‘হতে পারে। কিন্তু
ভিডিয়োটা দেখে কিন্তু উলটোটাই মনে হয়।’
—‘তাহলে আমার কিছু করার নেই।’ এই প্রথম ওর গলা থেকে অমায়িকভাবটা
ঝরে গেল, ‘বর্ন ইন ক্যালকাটা,
ব্রট-আপ অ্যামং বেঙ্গলিজ, অফিসের ম্যাক্স স্টাফ বেঙ্গলি, বাড়িতে সারভেন্টস বেঙ্গলি,
ড্রাইভার বেঙ্গলি…’
এই অবধি শুনে আমি শব্দ করে হেসে উঠলাম। নবমিতাও মাথা নীচু করল। ইচ্ছে করেই সুমিতের থতমত মুখের ওপর খানিকক্ষণ আরোপিত হাসিটা
চালিয়ে যেতে যেতে বললাম, ‘ডিয়ার মিস্টার জয়সওয়াল,
কিছু মনে কোরো না। বলতে বাধ্য হচ্ছি, যাকে ‘সন্মান করা’ সম্পর্কে তোমার ধারণা ইস প্রবেলম্যাটিক অ্যাট সো মেনি লেভেলস। তুমি কি ওর বাবা-মায়ের সামনেও এইসব বলে এসেছ নাকি? কীরে নবমিতা,
এইসব বলেছে? তুমি আমাদের সম্মান করো, বেশ কথা, তার প্রমাণ কী? বেশিরভাগ
বন্ধুবান্ধব বাঙালি, মানে বাঙালিদের সঙ্গে মিশতে ভালো লাগে?
নাঃ! বাঙালি পাড়া-প্রতিবেশীদের
সঙ্গে খুব মিলমিশ? নাঃ! প্রমাণ হল চাকর-বাকর সব বাঙালি! তুমি কি বুঝতে পারছ এটা কত বড় একটা স্টেটমেন্ট?
নবমিতা, তুই কি বুঝতে পারছিস? সত্যি বলতে কি এতদিন মাঝেমাঝে আমারও মনে হয়েছে সেদিন ওই পরিস্থিতিতে তুমি যা
বলেছ আসলে সেগুলো বিশ্বাস করো না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওই পরিস্থিতি শুধু তোমার মুখোশটা খুলে
দিয়েছে। তোমার আসল মনোভাব হল
তুমি বাঙালিদের প্রভু। তাই তাদের স্পর্ধা, তা সে যতই যুক্তিযুক্ত হোক না কেন, দেখলে তোমার মনে হয়
তাদের চাবকে দেওয়া উচিত।’
কথা বলতে বলতে সুমিতের মুখভঙ্গির পরিবর্তনটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলাম। এখন ওকে চেনা-চেনা ঠেকছে, ঠিক ওই ভিডিয়োটায় যেমন দেখাচ্ছিল। কী একটা বলতে যাচ্ছিল, আমি হাত তুলে বললাম, ‘আয়াম নট ফিনিসড ইয়েট। এবারেই আসল কথা। নিশ্চয়ই এটাও দাবি করবে নবমিতাকে তুমি খু-উ-ব ভালোবাসো, রাইট? আচ্ছা তুমি ওর পছন্দ-অপছন্দকে
কতখানি মূল্য দাও? মানে ধরো, আমি জানি ও
একটা বিশেষ ঘরানার বাংলা সিনেমা দেখতে খুব পছন্দ করে। তুমি ওর সঙ্গে ওইরকম ক’টা বাংলা ছবি দেখতে গেছ? আগে দেখতাম পয়লা
বৈশাখ বা অষ্টমীর দিন ও কাকু-কাকিমাকে নিয়ে বাঙালি খাবার খেতে
গেছে। কই তোমার সঙ্গে তো সেরকম
কিছু দেখলাম না এবার…’
—‘সন্ময়-দা-আ…’ নবমিতার ডাকের আকুতিটা আমার কান এড়াল না। কিন্তু ততক্ষণে সেই সাইক্লোন আমার বুকের আড়াল থেকে বেরিয়ে
প্রবল গতি সঞ্চার করে ফেলেছে, ‘এই
আধঘণ্টার মধ্যে তুমি একাধিকবার ওর কথার মাঝখানে কথা বলে উঠলে। বারবার ওকে থামিয়ে দিচ্ছ। ওর কথা শোনার মতো ধৈর্য্যটুকু যেখানে তোমার নেই, সেখানে আমরা কী করে বিশ্বাস করব যে লংটার্মে
তুমি ওকে ভালো রাখবে? বাঙালিদের তো অনেক দূরের ব্যাপার,
যে-মেয়েটির সঙ্গে তুমি জীবন কাটাতে চাও,
তাকেই সম্মান করো না—’
—‘ওকে, ওকে ফাইন’ এই উদ্ধত ভঙ্গিটারই
অভাব ছিল এতক্ষণ ‘আই গেট ইয়োর পয়েন্ট। ইউ থিংক আই অ্যাম টোটালি আনসুটেবেল ফর রাই। ওয়াট দেন?’
—‘দেন’ এইবার আমার শান্ত হওয়া প্রয়োজন, তাই আস্তে আস্তে বললাম, ‘দেন… যদি
সত্যিই আমার মতামত রাইয়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে, আই উইল
ট্রাই মাই বেস্ট টু স্টপ দিস ম্যারেজ।’
—‘নট হ্যাপেনিং। সরি টু
সে, বাট ইউ ওয়ার রাইট আর্লিয়ার, ইয়োর অপিনিয়ান ইস নট দ্যাট ইমপরট্যান্ট। সে যতই রাই আপনাকে দাদা-দাদা করুক না কেন।’
—‘আমি এটা ওর দাদা হিসেবে বলছি না সুমিত’ চেষ্টা করছিলাম
কথাটা বলার সময় যতটা সম্ভব শান্ত থাকার, তাই নবমিতার দিকে তাকিয়ে
বললাম, ‘বলছি এক পুরুষ হিসেবে যে এক নারীকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে
ভালোবাসে… আর কাছে পেতে চায়।’
কথাটার প্রতিক্রিয়া যেমন হওয়ার কথা ছিল ঠিক সেই রকমই হল। নবমিতা থমকে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমিও ওর দিকেই চেয়েছিলাম। বুঝতে পারছিলাম কী হতে চলেছে, তাই চেষ্টা করছিলাম চোখ ভরে যতটা ওকে দেখে নেওয়া
যায়…
সুমিতও থতমত খেয়ে গেছিল। কিন্তু ওর গলাই প্রথম কানে এল, ‘ওয়াট দ্য ফাক! রাই!
সো দিস ইস ইয়োর গ্রেট দাদা যার কথা তোমার শেষই হয় না। দিস… দিস
ডার্টি ফেলো… যে মুখে বোন ডেকে মনে মনে… মাই গুডনেস!’
তা-ও নবমিতার দিক থেকে
আমার চোখ সরে না। তাই বোধহয়
সুমিতও আবার শুরু করে, ‘নো ওয়ান্ডার হিস ওয়াইফ
ডাম্পড হিম। যেই বউ পালিয়েছে অমনি
আর-একটা মেয়ে চাই। সে আবার এসেছে বেঙ্গলি
কালচার নিয়ে আমাকে লেকচার দিতে! ইয়াক!
রাই, কাম অন নাউ, হ্যাভ সাম
সেলফ-রেসপেক্ট অ্যান্ড ডু মি আ ফেভার… লেটস
গেট আউট অফ হিয়ার!’ বলে টেবিলের ওপর ক’টা
নোট ছুঁড়ে ফেলে গটগট করে বেরিয়ে গেল।
নবমিতা তখনও ওঠেনি। ওর চোখের
কোল আমার চোখের সামনেই ধীরেধীরে জলে ভরে এল। তারপর চোখ থেকে প্রথম ফোঁটাটা গড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ও বলল, ‘এটা কী করলে সন্ময়দা! আমি যে কখনোই তোমাকে এভাবে…’
—‘ভাবিসনি। জানি রে! কিন্তু আমি যে তোকে… খুব…
মানে খুব… আসলে বাড়িটাতে তো একদম একা, তুই তো জানিসই, সবই বলেছি তোকে… একা… আর দিনরাত শুধু তোর কথাই ভাবি… একা একা ভালো লাগে না… তুই… থাকবি
রে আমার সঙ্গে? থাকবি? থাক না রে…’
নবমিতা দু’হাত দিয়ে মুখ ঢাকল।
ওর চলে যাওয়াটা আবছা দেখলাম। তারপর থেকে
সেই যে চারিপাশটা ঝাপসা হয়ে গেল… ছায়া-ছায়া… অর্থহীন… আর কী শান্ত…
কী শূন্য!
হয়তো চিরতরে…
No comments:
Post a Comment