ফুনেস'কে
মনে পড়ে ('মনে পড়ে' বললে অবশ্য এক্ষেত্রে অনধিকার চর্চা হয়; বিশুদ্ধ স্মরণশক্তির
অধিকার এ' পৃথিবীতে শুধু একটি মানুষের ছিল, সে এখন মৃত), সে তখন হাতে একটি গাঢ়
রঙের প্যাশনফ্লাওয়ার নিয়ে সেটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। সেই দেখা অবশ্য এক
অন্যরকম দেখা। সমস্ত জীবন ঐ ফুলের দিকে সকাল সন্ধে চেয়ে থাকলেও যেন ঠিক ওর মতনটি
করে আর কেউ দেখতে পাবে না। মনে আছে, ঠোঁটের ঝুলন্ত সিগারেট, তার ওপারে যেন বহু
দূরবর্তী ওর শান্ত, দেশজ মুখাবয়ব। লেদার বোনে যারা, সমতলের সেই সোগুয়েরো
কারিগরদের মতো শক্তসমর্থ, কিন্তু মোলায়েম হাতের আঙুল। হাতের কাছে, যতদূর মনে পড়ে,
লাউখোলের তৈরি 'মাতে' চায়ের পাত্র, তাতে বান্ডা ওরিয়েন্টাল-এর রাষ্ট্রীয় প্রতীক
আঁকা; মনে আছে ফুনেসের বাড়ির জানালায় হলদে রঙের মাদুরের পর্দা, পর্দার ওপারে
জলাভূমির দৃশ্য। স্পষ্ট মনে পড়ে ওর কণ্ঠস্বর, পূর্বের শহরতলীর বৃদ্ধদের মতো
অনুচ্চ, অনুনাসিক, বিরক্তিসূচক। ওর উচ্চারণ ছিল হালফিলের ইতালিয়ান প্রভাবমুক্ত।
ফুনেসের সঙ্গে আমার সাকুল্যে তিনবার দেখা হয়েছে, শেষবার সেই ১৮৮৭তে...
ফুনেস'কে
যারা চিনতেন, তাঁরা যে সকলেই এই সংখ্যায় লিখছেন, এ আমার কাছে বড় আনন্দের বিষয়।
সেইসব লেখার মধ্যে আমার এই এজাহারটিই বোধকরি, সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত, সবচেয়ে নীরস এবং
অনেকাংশে পক্ষপাতদুষ্ট হবে। কী করব বলুন? উরুগুয়ানরা যেমন উরুগুয়ের বিষয়ে কিছু
লিখতে গেলেই চমৎকার সব
প্রশস্তি বাঁধতে
পারেন, আমি সেই ধ্রুপদী কারিগরি কোথায় পাই? আমি যে নগন্য আর্জেন্টাইন।
'শহুরে',
'আঁতেল', 'সেয়ানা' - না, ফুনেস কখনো আমায় এইসব অবমাননার সম্বোধনে ডাকেনি, কিন্তু
ওর কাছে আমি এইসব ধারণাই যে বয়ে আনি, আমি তা ভালোই বুঝি। সে আমারই দুর্ভাগ্য। কবি
পেদ্রো লেয়ান্দ্রো ইপুশে লিখেছেন, ফুনেস ছিল এক অতিমানবের পূর্বসূরী, 'এই মাটিরই
অজেয় এক জরাথুস্ট্র'। সন্দেহ নেই। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সে ছিল ফ্রে বেন্তস নামক
এই ছোট্ট শহরেরই বাসিন্দা। কিছু অমোঘ সীমাবদ্ধতাও ছিল তার।
ফুনেস'কে
প্রথমবার দেখার স্মৃতি আমার মনে এখনও বেশ পরিষ্কার। ১৮৮৪'র মার্চ কি ফেব্রুয়ারি
মাস হবে। সেবার আমার বাবা আমাকে গরমের ছুটি কাটাতে ফ্রে বেন্তস শহরে নিয়ে গেছিলেন।
সেটা ছিল এক গোধূলিবেলা, আমি আর আমার খুড়তুতো ভাই বের্নার্দো আয়েদো, সান
ফ্রান্সিসকোর খামার থেকে ঘোড়ায় চেপে বাড়ি ফিরছি। সারাদিন গুমোট গরমের পর আকাশ কালো করে ঝড়
আসছে, দক্ষিণের ঝোড়ো বাতাসে গাছপালা উন্মত্ত হয়ে দুলছে। ভয় হচ্ছিল, খোলা
প্রান্তরে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে না পড়ে যাই। ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা
দিয়ে ঘোড়া ছোটাচ্ছি। একটা গলির মতো পথ পাওয়া গেল, তার দুই দিকে দেয়াল-সমান উঁচু
ইঁটের ফুটপাথ চলে গেছে। চারিদিক কালো করে এসেছে, হঠাৎ সেই ফুটপাথের উপর থেকে দ্রুত
পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। চোখ তুলে চেয়ে দেখি একটি ছেলে সেই সরু, অমসৃণ পথ ধরে
ছুটছে। পরণে একটা ঢোলা গাউচো পাজামা, পায়ে চটি, কঠিন চোখমুখ, কালো হয়ে আসা ঝোড়ো
আকাশের দিকে সিগারেট উঁচিয়ে ধরে আছে ওর ঠোঁট। বের্নার্দো ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে উঠল, "ক'টা
বাজল, ইরিনেও?" না থেমে, আকাশের দিকে না তাকিয়েই ইরিনেও উত্তর দিল:
"আটটা বাজতে চার বাজে হে, তরুণ বের্নার্দো হুয়ান ফ্রান্সিসকো।" কিছুটা
বিদ্রুপের সুর মাখানো, তীক্ষ্ণ সেই কণ্ঠস্বর।
আমি
কিছুটা অন্যমনস্ক ছিলাম। এই উত্তর আমার মনে থাকার কথা নয়, যদি না বের্নার্দো পরে
আবার এই প্রসঙ্গ তুলত, ইরিনেও'র তাচ্ছিল্য সে যে গায়ে মাখেনি তা বোঝাতে।
বের্নার্দো'র কাছেই জানা গেল ছেলেটির ভালো নাম ইরিনেও ফুনেস।ক্ষ্যাপাটে বলে তার খ্যাতি রয়েছে। বিশেষ মিশুকে
নয়। কিছু অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে তার, যেমন দিনের যে কোন সময়ে ঘড়ি না দেখেও নির্ভুল সময় বলে দিতে পারে। মায়ের নাম মারিয়া ক্লেমেন্তিনা ফুনেস, তাঁর একটি ইস্ত্রির দোকান রয়েছে। ওর
পিতৃপরিচয় নিয়ে কিছুটা ধন্ধ রয়েছে, কেউ বলে তিনি ও'কনর নাম্নী একজন ব্রিটিশ, একটি
মাংসের ব্যবসায়ে কাজ করতেন, আবার কেউ বলে তিনি ছিলেন সালতো জেলা থেকে আগত একজন
স্কাউট, বুনো ঘোড়াদের পোষ মানানোর কাজ করতেন। ফুনেস ওর মায়ের সঙ্গেই থাকত,
লরেল'দের পাড়ায়।
আঠারোশ'
পঁচাশি আর ছিয়াশির গ্রীষ্মকাল আমরা মন্তেভিদেও শহরে কাটাই। সাতাশি সালে আমি ফিরে
গেলাম ফ্রে বেন্তসে। সেখানে পৌঁছে আমি স্বাভাবিক ভাবেই পূর্বপরিচিতদের খোঁজ করলাম,
খোঁজ করলাম সেই 'কালজ্ঞ' ফুনেসের। জানতে পারলাম, সান ফ্রান্সিসকোর খামারে একটি
বুনো ঘোড়া নাকি ফুনেস'কে পিঠ থেকে ছুঁড়ে ফেলে সবিশেষ বিপত্তি ঘটিয়েছে, ফুনেস
এখন পঙ্গু। বের্নার্দোর মুখে এই ঘটনার বিবরণ শুনতে শুনতে আমার কেমন অস্বস্তি
হচ্ছিল। মনে পড়ছিল, সান ফ্রান্সিসকো থেকে ঘোড়ায় চড়ে ফেরার পথে শেষবার যখন
ফুনেস'কে দেখেছিলাম, সে তখন সেই উঁচু ফুটপাথ ধরে দৌড়ে যাচ্ছিল। কোনো কোনো দুঃস্বপ্নের ভিতরে যেমন চেনা
দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হয়, আমার সেরকম
একটা অনুভূতি হচ্ছিল। জানা গেল, ইরিনেও এখন
নিজের বিছানা ছেড়ে কোথাও যেতে পারে না, সে এখন
উঠোনের অশ্বত্থগাছের দিকে, কিংবা কড়িকাঠের মাকড়সার
জালের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে দিন কাটিয়ে দেয়। শুধু বিকেলের দিকে ওকে জানালার কাছে
এনে বসাতে সম্মতি দেয়। এমনই নাকি ওর গুমর, হাবেভাবে মনে হয় দুর্ঘটনাটা হয়ে ওর ভালোই
হয়েছে... ওকে আমি দু'বার ওর জানালার লোহার জাফরির পিছনে বন্দীর মতো বসে থাকতে
দেখেছিলাম; স্থানুবৎ, দুই চোখ বোজা; আরেকবার, সেই একই ভাবে বসা, হাতে শুকনো
ল্যাভেন্ডার, তার গন্ধে তন্ময়।
আমি
তখন বেশ ঘটা করে ল্যাটিন শিখতে শুরু করেছি। লোমন্ড'এর 'দে ভিরিস ইলাস্ট্রিবাস',
ক্যুইশেরাত'এর 'থিসরাস', সিজারের 'কমেন্ট্রিজ্', প্লিনি'র 'হিস্টোরিয়া নাচুরালিস্'
- এইসব বই ব্যাগে নিয়ে ঘুরি, যদিও আমার সীমিত ল্যাটিনের জ্ঞান নিয়ে সেইসব বইয়ের বিষয়বস্তুতে বিশেষ দাঁত
ফোটাতে পারি না। ফ্রে বেন্তসের ছোট্ট জনপদে এই খবর চাউর হতে বেশি সময় লাগলো না। খুব শিগগিরই সে কথা
ইরিনেও'র কাছেও পৌঁছে গেল। সে আমায় বেশ জাঁকিয়ে একটি চিঠি লিখল। সেই চিঠিতে
"চুরাশি'র সাতই ফেব্রুয়ারি" তারিখে আমাদের প্রথম সাক্ষাতের উল্লেখ ছিল।
উল্লেখ ছিল আমার কাকা ডন গ্রেগোরিও আয়েদো'র, যিনি সেই চুরাশি সালেই দেহ রেখেছেন।
ফুনেস তার চিঠিতে লিখেছিল, ডন গ্রেগোরিও এককালে "আমাদের দুটি দেশের (বান্ডা
ওরিয়েন্টাল এবং আর্জেন্টিনা) স্বাধীনতার জন্য ইতুসাইঙ্গ'র যুদ্ধে অতুলনীয়
বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন।" সেই চিঠিতেই
ইরিনেও আমার হিস্টোরিয়ানা চুরালিস'এর যে কোনও একটি খণ্ড ওকে কিছুদিনের জন্য ধার
দিতে অনুরোধ করে। সঙ্গে চেয়ে পাঠায় একটি ল্যাটিন অভিধান, যাতে করে "মূল
গ্রন্থটি আরো ভালো ভাবে পাঠ করা যায়। আমি এখনও পর্যন্ত ল্যাটিন জানি না।"
প্রতিশ্রুতি দেয়, বইগুলি সে অনতিবিলম্বে অক্ষত অবস্থায় ফেরত দেবে। চিঠির
হস্তাক্ষর ছিল পরিষ্কার, ঝকঝকে, বানানবিধি ছিল আন্দ্রে বেল্লো'র ঘরানার: 'y'এর
জায়গায় 'i', 'g'এর জায়গায় 'j'।প্রথমে স্বাভাবিক ভাবেই ভেবেছিলাম, এ নিশ্চয়ই
ইরিনেও'র মস্করা। কিন্তু তারপর আমার ভাইয়েরা জানালো, মস্করা নয়, ইরিনেও এরকমই। আমি বুঝতে
পারছিলাম না, কেবলমাত্র একটি অভিধান সম্বল করে ল্যাটিনের মতো কঠিন ভাষা আয়ত্ত করে
ফেলার এই পরিকল্পনাকে ধৃষ্টতা বলব, না মূর্খতা। যাইহোক, ওর ভ্রান্তি কাটানোর জন্যই ওকে ক্যুইশেরাত'এর
'গ্রাদুস আদ পার্নাস্সুম' আর প্লিনি'র বইখানা পাঠিয়ে দিলাম।
চোদ্দোই
ফেব্রুয়ারি বুয়েনোস আইরেস থেকে আমার জন্য একখানা
টেলিগ্রাম এল, আমি যেন দ্রুত বাড়ি ফিরে যাই, বাবার শরীর "একেবারেই ভালো
নয়"। ঈশ্বর ক্ষমা করুন, জীবনে প্রথমবারের জন্য এমন জরুরী তলব পেয়ে নিজের
ভিতরে কেমন যেন একটা গুরুত্বের, সম্ভ্রমের বোধ হল। সাধ জাগল, ফ্রে বেন্তসের সকলকে
ডেকে দেখাই, এমন আশঙ্কাজনক সংবাদ পেয়েও কেমন দুঃখেষ্বনুদ্বিগ্নমনা পৌরুষ নিয়ে চলছি। সত্যি বলতে কী,
সত্যিকারের বেদনা যে আসতে পারে, এতসব ভাবনায়
সে সম্ভাবনা সম্পর্কে খানিকটা অন্যমনস্কই
হয়ে পড়েছিলাম। ব্যাগ গোছাতে গিয়ে খেয়াল হল, ফুনেসের কাছ থেকে 'গ্রাদুস' আর 'হিস্টোরিয়া নাচুরালিস' ফেরত নেওয়া হয়নি। সন্ধের খাবার খেয়ে ফুনেসের বাড়ি ছুটলাম।
দিন ফুরিয়ে রাত নেমেছে,ভারাক্রান্ত হয়ে আছে আমার মন।
ছোট্ট
একটি র্যাঞ্চের ভিতর ফুনেসের বাড়ি। ওর মা আমায় অভ্যর্থনা করলেন। জানালেন, ইরিনেও
ভিতরে রয়েছে। বললেন, ওর অন্ধকার ঘরে গিয়ে বসতে আমি যেন অস্বস্তি বোধ না করি।
ফুনেসের ওভাবেই থাকার অভ্যাস হয়ে গেছে।
খোয়াপাথরের প্যাটিও, তারপর একটা ছোট করিডোর পেরিয়ে বাগানঘেঁষা ভিতরের বারান্দায় পৌঁছনো গেল। আশেপাশে আঙুরের লতা ঝাঁকড়া হয়ে আছে, অন্ধকার আরো জমাট হয়েছে
তাতে। তারই মধ্যে ইরিনেও'র তীক্ষ্ণ, বিদ্রুপ মেশানো গলায় ল্যাটিন ভাষায় কোনো
স্তব বা মন্ত্রোচ্চারণ শোনা গেল। সেই গলায় কিছুটা পুলকের ছোঁয়া স্পষ্ট। আমি
খানিকটা অসোয়াস্তি
নিয়ে শুনতে লাগলাম। কাঁচা বারান্দায় অন্ধকারে রোমান অক্ষরসমূহ ধ্বনিত হচ্ছে, আর
আমি তার অর্থ প্রায় কিছুই উদ্ধার করতে পারছি না। পরে, ওর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপের
অবকাশে জানতে পেরেছিলাম, ফুনেস তখন হিস্টোরিয়া নাচুরালিস' এর সপ্তম
ভাগের চব্বিশতম অধ্যায়ের
প্রথম অনুচ্ছেদটুকু পাঠ করছিল। সেই অধ্যায়ের বিষয়বস্তু- 'স্মৃতি';
যার শেষ ক'টি পংক্তি ছিল - 'ut nihil non
iisdem verbis redderetur auditum' - যা কিছু একবার শ্রুত, তাকে ঐ একই
শব্দে দ্বিতীয়বার বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
পাঠ
শেষে, সেই একই কণ্ঠস্বরে ইরিনেও'র আমায় অভ্যর্থনা জানালো। সে তখন
বিছানায় শুয়ে ধূমপান করছে। যতদূর মনে পড়ে, ভোরের
আগে আমি ওর মুখ দেখতে পাইনি, শুধু থেকে থেকে সিগারেটের আগুনের আঁচ। ঘরে একটা
স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ। বসলাম, টেলিগ্রামের কথা বললাম, বাবার অসুস্থতার কথা বললাম।
এই
গল্পের সবচেয়ে দুরূহ অংশে আসা যাক এবার। পাঠক ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন,
প্রায় অর্ধশতাব্দী আগের সেই কথোপকথনটুকু ছাড়া এই কাহিনীতে সারাংশ বলতে আর বিশেষ
কিছু নেই। আমি সেই কথোপকথনের পুঙ্খানুপুঙ্খ পুনরাবৃত্তি করব না, তা সম্ভবও নয়।
বরং ইরিনেও সেদিন যা যা বলেছিল, সংক্ষেপে তার সারমর্ম তুলে ধরতে চেষ্টা করব। তাতে
হয়তো এই লেখার প্রসাদগুণ কতকটা নষ্ট হবে, কিন্তু আশা করি,
পাঠক সেই আবছায়া আলাপচারিতার
একটা পূর্ণরূপ নিজগুণে
রচনা করে নেবেন।
হিস্টোরিয়া নাচুরালিস
থেকে অব্যর্থ স্মৃতিশক্তির নজির টেনে, ল্যাটিন ও স্প্যানিশের মিশেলে নিজের
বক্তব্য শুরু করল ইরিনেও। পারস্যের রাজা সাইরাস তাঁর সেনাবাহিনীর প্রতিটি সৈনিকের
নাম জানতেন। মিথ্রিডাটিস ইউপেটর শাসনকার্য চালাতে তাঁর সাম্রাজ্যে ব্যবহৃত বাইশটি
ভাষা ব্যবহার করতেন। সিমোনিদিস আবিষ্কার করেছিলেন অব্যর্থ স্মৃতির কৌশল,
মেট্রোডোরুস ছিলেন দক্ষ শ্রুতিধর। ফুনেসের সরল প্রশ্ন, এইসব ঘটনার মধ্যে এমন কী
বিস্ময়কর ব্যাপার আছে। সে জানায়, সাম্প্রতিক এক বৃষ্টিধোয়া সন্ধ্যায় সেই নীচে-ধূসর ঘোড়া তাকে
মাটিতে ফেলে দেওয়ার আগে পর্যন্ত সে নিজেও আর পাঁচটা লোকের মতোই অন্ধ, বধির,
স্থূলবুদ্ধি এবং অমনোযোগী একটি মানুষ ছিল। আমি একথার মৃদু প্রতিবাদ জানাই, ওর নিপুণ সময়জ্ঞানের, নাম মনে
রাখার অব্যর্থ ক্ষমতার কথা তুলি। ইরিনেও সে কথায় পাত্তাই দিল না। সে বলে চলল,
জীবনের প্রথম উনিশ বছর সময় সে
যেন এক স্বপ্নের ঘোরে কাটিয়েছে। তখন তার দেখার মধ্যে সত্যিকার দৃষ্টি ছিল না,
শোনার মধ্যে মনোযোগ ছিল না, স্মৃতির চেয়ে বিস্মৃতি ছিল বেশি। ঘোড়ার পিঠ থেকে
পড়েগিয়ে সে জ্ঞান হারিয়েছিল; জ্ঞান ফিরে পেয়ে সে আবিষ্কার করে, তীক্ষ্ণ, তীব্র, প্রায় দুঃসহ
এক পর্যবেক্ষণ শক্তির অধিকারী হয়েছে
সে। এমনকি তার বহুপূর্বের, তুচ্ছতম
স্মৃতিগুলিও হয়ে উঠেছে তীব্র উজ্জ্বল, পরিষ্কার। জ্ঞান ফেরার কিছু পরে যখন সে তার
পক্ষঘাতের কথা জানতে পারে, তখন তার বিশেষ ভাববিকার ঘটেনি। মনে হয়েছিল, তার এই নবলব্ধ দৃষ্টি এবং
অভ্রান্ত স্মৃতিশক্তির দাম হিসেবে এই শারীরিক বিকলতা তো কিছুই নয়।
আমরা
হয়তো এক নজরে দেখলাম, টেবিলের উপর তিনটে ওয়াইন গ্লাস রাখা আছে। ফুনেস কী দেখছে?
সে দেখছে ঐ ওয়াইন যে আঙুর থেকে এসেছে, তার সবকটি লতা, সবকটি আঙুরগুচ্ছ। ১৮৮২'র তিরিশে এপ্রিলের ভোরে, দক্ষিণ
আকাশে মেঘের আকৃতি কেমন ছিল - তা ওর স্মৃতিতে স্পষ্ট। ওর স্মৃতির ভিতরে সেই আকৃতির
সঙ্গে জীবনে একবার মাত্র দেখা কোনো একটি স্পেনীয় বাঁধাইয়ের বইয়ের নকশার তুলনা চলতে থাকে। সেই বইয়ের
প্রান্তরেখার সঙ্গে তুলনা চলতে থাকে ফেনার; কেব্রাচো বিদ্রোহের আগের রাতে রিও
নেগ্রো নদীর জলে নৌকার একটি বৈঠা যে ফেনা তুলেছিল, সেই ফেনার আকৃতির তুলনা। এইসব
স্মৃতি আবার নিতান্ত সহজ সরল স্মৃতিমাত্র নয়। প্রতিটি দৃশ্যের সঙ্গে সেই সময়ে ওর
দেহের প্রতিটি পেশীসংকোচন, দেহের উত্তাপবোধ ইত্যাদির স্মৃতি জুড়ে আছে। নিদ্রায়,
বা তন্দ্রার মধ্যে দেখা প্রতিটি স্বপ্নকে নিখুঁত ভাবে মনে করতে পারে ফুনেস।
দুয়েকবার এমনকি এমন হয়েছে, একটি সম্পূর্ণ দিনের ঘটনা সে হুবহু স্মরণ করে দেখেছে,
তাতে আবার একটা গোটা দিন সময় লেগেছে। ফুনেস আমায় বলে, "আমার একার যত স্মৃতি
আছে, তা এই দুনিয়ার শুরুর দিন থেকে সকল মানুষের যত স্মৃতি আছে, তার চেয়ে বেশি
হবে।" বলে, "তোমাদের জেগে থাকা যেরকম, আমার স্বপ্নগুলো সেরকম।"
ভোরের আগে সে বলে, "জঞ্জাল, বুঝলে, স্মৃতির জঞ্জাল।"
আমাদের
মনে যেমন ব্ল্যাকবোর্ডে আঁকা একটি বৃত্ত, একটি ত্রিভুজ বা একটি আয়তক্ষেত্র কেমন
হতে পারে তার ধারণা থাকে, ইরিনেও'র রয়েছে একটি ছুটন্ত ঘোড়ার কেশর, পাহাড়ি রাস্তায়
গবাদি পশুর পাল, আগুনের ছটফটে শিখার প্রতিটি মুহূর্তের আকার, ছাইয়ের প্রতিটি কণার
আকার সম্পর্কে নির্ভুল ধারণা, মৃত মানুষকে দাফন করার আগে যখন সবাই শেষ শ্রদ্ধা
জানায়, সেই সময়ে প্রতি মুহূর্তে বদলাতে থাকা মৃতের মুখের আকার সম্পর্কে ধারণা।
রাতের আকাশের দিকে তাকালে ফুনেস কত শত-সহস্র তারা
দেখতে পায়, কে জানে।
ফুনেস আমায় যা কিছু বলেছিল, আমি কখনোই
তার সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করার কোনো কারণ দেখিনি। সেই সময় তো সিনেমা বা
ফোনোগ্রাফ ছিল না। ভাবতে অবাক লাগে, কেউ কখনও ফুনেস'কে নিয়ে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা
করার কথা ভাবল না? আসলে আমরা সবাই বোধহয় "ও পরে দেখা যাবে" ভেবেই জীবন
কাটিয়ে দিই, যেন আমাদের হাতে অনন্ত সময় রয়েছে, যেন একদিন না একদিন মানুষ যা কিছু
জানার তা জেনে ফেলবে, যা কিছু করার তা করে ফেলবে। অমরত্বে আমাদের প্রগাঢ় বিশ্বাস;
যা কিছু "পরে দেখা যাবে", তাকে অনন্তের জিম্মায় রেখে আমরা নিশ্চিন্তে
এগিয়ে যাই।
অন্ধকারের
মধ্যে ফুনেসের কণ্ঠস্বর
বলে চলে, ১৮৮৬ নাগাদ সে একটি নতুন ধরণের গননাপদ্ধতি
আবিষ্কার করে এবং কয়েক দিনের মধ্যেই চব্বিশ হাজার পর্যন্ত সকল সংখ্যার নতুন
নামকরণ করে ফেলে। সেই নামগুলি লিখে রাখার কোন প্রয়োজন সে বোধ করেনি, কারণ তার সমস্ত
চিন্তা তার স্মৃতির ভিতরে অবিকল রয়ে যায়। যতদূর মনে পড়ে, তার এই নতুন পদ্ধতি
আবিষ্কারের কারণ - ইতিহাসবিখ্যাত "৩৩ উরুগুয়ান" বিদ্রোহীর নামকরণ নিয়ে
তার একটি বিস্ময়। "৩৩ উরুগুয়ান" লিখতে দুটি অঙ্ক এবং একটি শব্দ লাগবে
কেন? একটি মাত্র সংখ্যাবোধক চিহ্ন এবং একটি শব্দ কেন নয়? পরবর্তীতে এই তত্ত্বের উপর
ভিত্তি করে সে সকল সংখ্যার ভিন্ন ভিন্ন নামকরণ শুরু করল। যেমন, সাত হাজার তেরোর
নাম হল হয়তো 'মাক্সিমো পেরেস', সাত হাজার চোদ্দর নাম হল 'সেই রেলগাড়িটি',
অন্যান্য সংখ্যার নাম দাঁড়ালো - লুইস মেলিয়ান লাফিনুর, ওলিমার, গন্ধক, বৃষ্টি,
চিড়িতন, সেই তিমি মাছটি, গ্যাস, সেই কড়াইটি, নেপোলিয়ন, আগুস্তিন দি ভেদিয়া।
পাঁচশো'র নাম হয়ে দাঁড়ালো 'নয়'। প্রতিটি শব্দ লেখার জন্য আলাদা আলাদা চিহ্ন, তার
মধ্যে শেষের দিকের চিহ্নগুলি বেশ জটিল। আমি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম সংখ্যা লেখার
পদ্ধতি তো আসলে এরকম অসংলগ্ন শব্দের সার্কাস নয়, বরং ঠিক তার বিপরীত। ৩৬৫ বলার
অর্থ - তিনটে একশো, ছ'টা দশ এবং পাঁচখানা এক। "এল নেগ্রো টিমতেও" বা
"মান্তা দে কার্নে" বললে এই সংখ্যাপদ্ধতির কিছুই যে বোঝা যায় না।
ইরিনেও ব্যাপারটা বুঝল না, নাকি বুঝতে চাইল না, ঠিক বোঝা গেল না।
সপ্তদশ
শতকে জন লক একবার এমনই একটি অসম্ভব ভাষার কথা প্রস্তাব করেছিলেন (পরে অবশ্য সে
প্রস্তাব তিনি নিজেই খারিজ করে দেন), যেখানে প্রতিটি ভিন্ন সামগ্রী, প্রত্যেক
প্রস্তরখণ্ড, প্রত্যেক পাখি এবং গাছের প্রতিটি প্রশাখার একটি করে আলাদা নাম থাকবে।
ফুনেসও একবার এরকম একটি ভাষা তৈরি করার কথা ভেবেছিল, কিন্তু পরে সেই পরিকল্পনা সেও
পরিত্যাগ করে, কারণ সেইসব নাম তার কাছে বড়ই একরকম, বড়ই অস্পষ্ট ঠেকেছিল। ফুনেসের
স্মৃতিতে তার দেখা প্রতিটি জঙ্গলের প্রতিটি গাছের প্রত্যেক পাতাই যে স্পষ্ট, শুধু
তাই নয়, প্রতিবার সেগুলিকে দেখার কিংবা স্মরণ করার ঘটনাও তার কাছে আলাদা আলাদা
ভাবে প্রতীত হয়। সে একবার ভেবেছিল, তার প্রতিটি অতীত দিনের স্মৃতিকে মোটামুটি
সত্তর হাজার স্মৃতির অধ্যায়ে সাজিয়ে নিয়ে সেগুলির আলাদা আলাদা নামকরণ করা যায়
কিনা। দুটি কারণে সেই পরিকল্পনাও সে পরে বাতিল করে। প্রথমতঃ এরকম একটি তালিকা
একবার তৈরি করলে তা আর স্মৃতি থেকে মুছে ফেলার উপায় নেই, এবং দ্বিতীয়তঃ এই
পরিকল্পনা বেশ কিছুটা অকাজেরও বটে। ফুনেস হিসেব করে দেখেছে, এই কাজ শুরু করলে তার
নিজের মৃত্যুর আগে তার সবকটি বাল্যস্মৃতিকেও সে সাজিয়ে উঠতে পারবে না।
ফুনেসের
যে দুটি পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করলাম (সংখ্যাক্রমের নামকরণ এবং সকল স্মৃতির নামকরণ) সেগুলি অসম্পূর্ণ
থেকে গেলেও তাতে একরকম অসাধারণত্ব
রয়েছে। সেভাবে দেখলে, এই পরিকল্পনাগুলি থেকে ওর চিন্তাজগতের একটা অস্পষ্ট ছবি যেন
পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে, ফুনেসের পক্ষে প্লেটনিক ধারণা, বিমূর্ততার ধারণা করা প্রায় অসম্ভব ছিল।
"কুকুর" শব্দটি বললে আমরা যেমন ঐ প্রজাতির ভিন্ন ভিন্ন আকার এবং
আকৃতিবিশিষ্ট পশুগুলিকে একই সঙ্গে ভাবতে পারি, ফুনেসের পক্ষে সেরকম ধারণা করা ছিল
কষ্টসাধ্য। শুধু তাই নয়, তিনটে চোদ্দো মিনিটে পাশ থেকে দেখা একটি কুকুর, এবং
তিনটে পনেরো মিনিটে সামনে থেকে দেখা ঐ একই কুকুরকে আমরা যে একই নামে ডাকি, এই
বিষয়ে সবিশেষ আপত্তি ছিল তার। আয়নায় নিজের মুখ, নিজের হাত দুটি দেখে প্রতিবারই
বিস্মিত হত সে। জোনাথন সুইফট যেমন
লিখেছেন, লিলিপুটদের রাজা ঘড়ির মিনিটের কাঁটার চলনও দিব্যি দেখতে পেতেন, ফুনেস প্রতিটি
পল-অণুপল জুড়ে দেখতে পেত ক্ষয়ের, অবক্ষয়ের, ক্লান্তির ধীর কিন্তু অমোঘ আক্রমণ।
মৃত্যুর এগিয়ে আসা, বাতাসের আর্দ্র হয়ে আসা অনুভব করতে পারত সে।
সামান্যলক্ষণবর্জিত, বহুবিচিত্র এবং অসহ রকমের মুহূর্তবদ্ধ এই পৃথিবীর সে ছিল
একাকী সাক্ষী। ব্যাবিলন, লন্ডন কিংবা নিউ ইয়র্কেরমতো শহরগুলি তাদের উচ্চকিত
আড়ম্বর দিয়ে মানুষের কল্পনাকে যুগে যুগে অভিভূত করে এসেছে, কিন্তু সেইসব হর্ম্যপুরীর রাজপথে, স্ফীত জনস্রোতে
একটি মানুষও বাস্তবের সেই প্রবল অনুপুঙ্খ রূপ কখনও দেখেনি, যা কিনা দক্ষিণ
আমেরিকার এক অখ্যাত শহরতলীর ছোট্ট বাসায় একাকী বসে অসুখী ইরিনেও দিনেরাতে
অনুভব করেছিল। ঘুমোনো বড় কঠিন কাজ ছিল ওর কাছে। দুনিয়ার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে
নিয়ে তবে ঘুমের কাছে যেতে হয়। ফুনেস ওর ঘরের প্রায়ান্ধকারে, খাটে হেলান দিয়ে
বসে, মনশ্চক্ষে পাড়ার প্রতিটি বাড়ির দেয়াল, সেগুলির প্রতিটি খাঁজ-ভাঁজ, ইঁট,
কাঠ, সুড়কি দেখতে পেত (মনে রাখতে হবে, আমরা যে স্পষ্টতায় আমাদের শারীরিক
ব্যথা-বেদনা, কিংবা আরামের বোধ পাই, ফুনেসের কাছে ওর তুচ্ছতম স্মৃতিগুলিও ছিল তার
চেয়ে বহুগুণ বেশি প্রত্যক্ষ) । ওর বাড়ির পূর্বদিকে যে জমিগুলি তখনও ব্লক হয়ে ওঠেনি, সেখানে
ততদিনে নতুন কতগুলি বাড়িহয়েছে, সেসব বাড়ি ফুনেস নিজে চোখে দেখেনি। ওর কল্পনায়
সেই বাড়িগুলি কালো রঙের, ঘনসন্নিবদ্ধ, একরকম ধোঁয়াটে পিণ্ডবৎ;
সেইদিকে ফিরে ঘুমোনোর চেষ্টা করত ফুনেস।
কল্পনা করত, সে যেন জলস্রোতে দুলতে দুলতে একটি নদীর গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে।
অনায়াসে ইংরেজি,
ফরাসী, পর্তুগিজ ও ল্যাটিন ভাষা শিখে ফেলেছিল ফুনেস। আমার অবশ্য মনে হয়, চিন্তন
বলতে ওর বিশেষ কিছু ছিল না। চিন্তা করার অর্থ হলো পার্থক্য'কে, বিশেষকে ভুলতে ভুলতে
সামান্যের দিকে, বিমূর্তের দিকে এগিয়ে যাওয়া। বিশদ তথ্যে ঠাসা ছিল ফুনেসের পৃথিবী,
সেই পৃথিবীতে ছিল কেবল দমবন্ধ করা খুঁটিনাটি স্মরণের ভিড়।
আঁধার
ফুঁড়ে ভোরের আবছা আলো সেঁধিয়ে এল মাটির বারান্দায়। সারারাত ধরে যার
কণ্ঠস্বর আমার সঙ্গে গল্প করে গেল, আমি এতক্ষণে তার মুখ দেখতে পাই। ইরিনেও'র বয়স তখন
উনিশ; ওর জন্ম ১৮৬৮'এ; ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য মনে হয় ওকে দেখে, মিশরের চেয়ে প্রাচীন,
পিরামিডের চেয়ে, সেকালের ভবিষ্যতদ্রষ্টাদের থেকেও যেন প্রাচীন। আমার মনে হল আমার
প্রতিটি কথা, প্রতিটি দেহভঙ্গি ওর নিষ্করুণ স্মৃতিপটে চিরকালের জন্য উৎকীর্ণ হয়ে
রয়ে গেল। বিবশ হয়ে ভাবতে লাগলাম, অনাবশ্যক পুনরাবৃত্তি হল
না তো কিছু?
১৮৮৯
সালে ফুসফুসে জল জমে ইরিনেও ফুনেসের
মৃত্যু হয়।
অনুবাদক বাংলা ভাষা এবং ইংরেজি সাহিত্যের প্রাক্তন শিক্ষক। বর্তমানে ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণারত।
জড়তাহীন অনুবাদ। বোর্হেসের লেখাকে ঠিক 'সুখপাঠ্য' বলা হয়তো ঠিক হবে না, কিন্তু তাঁর চরিত্রগত যে বহমানতা, সেটা অনুবাদেও ধরা পড়েছে। ভালো লাগল।
ReplyDelete