বাক্‌ ১৪৮ ।। বনমালী মাল

বর্ণবিপর্যয়

 

ধরা যাক...

‘নাহ্ আমার এখন কিচ্ছু চাই না একটু ঘুম চাই নীরবতা চাই বিরক্ত করতে চেয়ে বিরক্ত করবেন না

বাসের এই তিনজন যাত্রী যদি এই মুহূর্তে বিমানে বসে থাকতেন এবং একজন বিমানসেবিকা, সুন্দর বিমানসেবিকা কাছে এসে ‘আপনি কিছু নেবেন স্যার?’ জনে জনে এসে বললেও তাঁরা সবাই এই একই কথা বলতেন একই সুরে কোনো একটা কথাও না বলতে চাওয়ার দৃষ্টিতে ঝিমিয়ে পড়া, ধারালো ভাঙা কাচ বিছানো রাস্তায় হেঁটে আসার যন্ত্রণাকাতর চোখ নিয়ে

   

ধরা যাক

বাসে ঠাসাঠাসি তো নয়ই, ভিড়ই নেই এমনকি কোনো কোনো সিট খালি বাসটা আসছে কলমডাঙা থেকে কালিনগরে গিয়ে থামবে কলমডাঙায় উঠে একেবারে শেষ স্টপেজ কালিনগর তিনজন ক খ গ তিন বন্ধু বয়সের সামান্য ফারাক বোঝা যায় না কর্মসূত্রে কলমডাঙায় থাকে বছর চারেক তিনজনই একই বাসে যাতায়াত করে সপ্তাহান্তে বাড়ি ফেরার সময় সারা সপ্তাহ কলমডাঙায় কাটাতে আর একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুবাদে একে অন্যের প্রতি নিরীহ প্রেমিক অসম্ভব গাঢ় বন্ধুত্ব এক মুহূর্তে মন কষাকষি হলেও বনি আর বনার জন্য পরমুহূর্তেই তিনটি ছায়া এক হয়ে একটা প্রগাঢ় ছায়া তৈরি করে

কলমডাঙার উন্নয়ন প্রকল্পে সরকার এই ক’ বছর বেশ তীক্ষ্ম নজরদারি রেখেছে একটা সময় ছিল কলমডাঙার, যখন খুব কম ভোটার শাসক সরকারের অবাধ্য হত বা ভোট দিত বিপক্ষে সরকার তখন বুঝত, নজর না দিলেও চলবে কলম থেকে নিশ্চিত কালি বেরোবেই— এই ভেবে কোনো সময় কলমের খাপ খোলা থাকত কখনো কলম গড়াগড়ি খেত ধুলায়— নিবের মুখের যত্নের পরোয়া না করে কিন্তু গত কয়েক বছরে কলমডাঙায় অনেক নতুন বিছানা হয়েছে হাঁড়ি বেড়েছে আর অনেক লোক স্বপ্ন দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়েছে মুছে ফেলেছে আবার দেখেছে এখন তারা বিরোধ করতে শিখেছে একটা সুন্দর করে বোনা ঝুড়ি বিক্রি না হলে তারা খুলে তা থেকে অন্য কোনো জিনিস তৈরি করে না বরং সেটাকে পুড়িয়ে দেয়

কলমডাঙার দক্ষিণ আর পূর্বদিক জুড়ে নদী চওড়া পেট ভার সমুদ্র থেকে খুব কাছাকাছি বলে গর্বের শেষ নেই তার কলমডাঙা এখন বুঝতে পারে, নদী আর সমুদ্রে ঘেরা থাকলে তাদের স্বপ্ন দেখতে সুবিধে হয় সবগুলোই ভোরের স্বপ্ন সমুদ্র থেকে নদী থেকে রঙিন শামুক রাতবিরেতে কলমডাঙায় উঠে আসে ছেলে, বুড়ো সবাইকে আকাশে নিয়ে গিয়ে ভাসিয়ে দেয় প্রত্যেক শামুক নিজের সঙ্গে নিয়ে গিয়ে এক-একজনকে মায়া দেখায় রঙিন মায়া দিন দিন শামুকের এই খেয়ালিপানা বাড়তেই কলমডাঙার আপামর বুঝতে পারে, আমাদের কলমডাঙা আরও উন্নত হতে পারে হতে পারে কোনো কুয়াশা পোড়ানো সূর্য যে আলোয় ভর করে আমরা নিশ্চিন্ত ঘুম আর বিছানা পাব একটা পোক্ত রাস্তা পাব, যার পিঠের রেখা ধরে আমরা অনেক উঁচু শিখরে যেতে পারি

এই বোধের জন্মতারিখ থেকে কলমডাঙার মানুষগুলো রাতারাতি বদলে গেল সরকার এতদিন তাদের কী দিয়েছে, আর কী কী থেকে বঞ্চিত করেছে, এর তালিকা চূড়ান্ত করে নিল ভোর ভোর বসে শুকতারা থেকে রাতচরা পর্যন্ত তারা মেতে রইল তাদের দাবি নিয়ে হাত উঁচিয়ে চোখ তীক্ষ্ম করে শাসক দল আর তার চ্যালাদের ঘুম কেড়ে নিতে চায়...

শালা, উ মানবেনি, অর বাপ মানবে

—এতদিন তলে তলে বেশ ভোগ করেছ গুরু! আর নয়

—যে কোনো মূল্যে আমাদের অধিকার আমরা ছিনিয়ে নেব

এদিকে শাসক দল যে যে মন্ত্র প্রয়োগ করে মন্ত্রী বসিয়েছিল, সেই সেই মন্ত্র আর ঝাড়ফুঁক শুরু করে সারি দেওয়া সদ্য সাবালক হওয়া আকাশমণি গাছগুলোর চোখের সামনে লজ্জা বিলিয়ে দুই দল শুরু করল মন্ত্র-তন্ত্র আর স্বপ্নের লড়াই এক-একবার স্বপ্ন জিতে যায় তার আনাড়িপনার জন্য আর মন্ত্রতন্ত্র জেতে লালচোখ কিংবা বেহুঁশ অমানবিকতা দিয়ে আকাশমণির প্রতি কারও নজর পড়ছে না তারা গোপনে শিখে নিচ্ছে জন্মান্তরে মানুষ হলে, কী কী করণীয়!

কলমডাঙার বাজার পেরিয়ে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে আছে একটা প্রাচীন মন্দির গা দিয়ে আরও একটু এগিয়ে গেলে ক খ আর গ-এর বাসা তারা প্রতি সকালে দাঁত ঘষে, চা-টোস্ট খায় বন্ধুত্বের জোর নিয়ে গর্ব করে এরপর খবরের কাগজের পাতায় চোখ বুলিয়ে আগাপাশতলা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা দেশের প্রতি, রাজ্যের উন্নতির প্রতি তাদের নজর আছে সর্বদা

—অমুক নেতা তুষুক জায়গায় গিয়ে যা যা বলেছে তা রাজ্যের ভবিষ্যতের জন্য বিপদ ডেকে আনবে

—আর কুড়ি বছরের মধ্যে দেশকে শীর্ষে নিয়ে যেতে হলে সবার এই এই কাজগুলি করা উচিত

—সংবিধান রক্ষার চেয়ে সংবিধান ভাঙার দিকেই আমাদের এখন বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত জগদ্দল পাথরকে আঁকড়ে ধরে দ্রুত দৌড়ানো যায় না

চায়ের কাপে চুমুক... সিগ্রেটের পুড়তে থাকার সঙ্গে এই আলাপ তর্কাতর্কি প্রতি সকালকে বেশ ভারী আর বুদ্ধিদীপ্ত করে তোলে সকাল থেকে বিকেল হয় সন্ধ্যার পর রাত্রি আর আসে না যদি না তারা সন্ধ্যায় শখের চায়ের দোকানটার গন্ধ মাখে বাজারের চিতানো বুক জুড়ে ঘামাচির মতন ঘিঞ্জি চা দোকান ক খ গ সেই দোকানেই চা-সিগ্রেট খায়, যেখানে স্বপ্ন আর মন্ত্র-তন্ত্রের ধ্বজাধারীরা নিজেদের ধ্বজা অপরের থেকে ওপরে ওড়ানোর জন্য লাফালাফি করে ন্যাঙচায় ক মিটিমিটি চোখে আগাগোড়া সব দেখে খ নরম কাদার মতন হাসি হেসে সামনে যে পক্ষ থাকে, তাকে সমর্থন জানায় গ আপাত গম্ভীর হলেও সময়ে সময়ে আন্তর্জাতিক তারিখরেখার মতন নিজেকে তিন ডিগ্রি পূর্বে বাঁকিয়ে স্বপ্ন আবার কখনও পাঁচ ডিগ্রি পশ্চিমে বাঁকিয়ে মন্ত্রতন্ত্রের জমি বাঁচায় বাঁচানোর চেষ্টা করে

সুদীপ টি স্টলের মুখে একটা বারো ওয়াটের সিএফএল লম্বা গলির মতন দোকানটার পাছা নির্লজ্জকে লজ্জা দিয়ে কতখানি বেড়ে গেছে পেছনের শেষ অব্দি যাওয়ার আগেই আলো দুর্বল হয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে পেছনের ওই সহজাত আবছায়া জাপটে বসে আছে ক খ গ ভোট সামনেই দুই দলের উত্তেজনার তরজা চরমে আকাশমণি গাছগুলো প্রতি মুহূর্তে অভিজ্ঞ হয়ে উঠছে আগামীকাল বুধবার কলমডাঙার ঐতিহ্য আর বিবর্তন সম্পর্কে স্কুল মাঠে বার্ষিক উৎসব শুরু হওয়ার দিন দু’ দল থেকেই হোমরাচোমরা নেতা আসবেন তাঁরা এতদিন কী কী করেছেন আর কী কী করতে পারেন— তার একটা দীর্ঘ তালিকা শোনাতে আজকে সুদীপ টি স্টলের বারো ওয়াটের আলো মাটিতে পড়ছে না সন্ধ্যা থেকেই কিছু ছায়া গ্যাঁট হয়ে বসে আছে কিছু ছায়া গঙ্গাফড়িংয়ের মতন একটু উড়ে একটু বসে জল মাপছে কথার ওপর কথা, তার ওপর উষ্ণ বাতাস ক্রমে ক্রমে কথাগুলো গরম হয়ে স্বাভাবিক নিয়মে হালকা হয়ে ওপরে উঠে যায় নির্দোষ আলোটাকে কেন্দ্র করে পাক খেতে থাকে ক খ গ আবছায়া থেকে গভীর অন্ধকারে নেমে যায় উত্তেজনার ভিড়ে তাদের মুখের থমথমে ভাব মিলে একাকার হয়ে গেছে অন্ধকারের সঙ্গে একটা আছোলা লাঠি এসে লাগল খ-এর ডানহাতের কবজিতে সামাল দিয়ে উঠতে না উঠতেই গ-এর বাঁ বাহু ঘেঁষে একটা গুলি পেছনের বাতা দেওয়া বেড়াটাকে কাঁপিয়ে তুলল

সারারাত ভাবতে ভাবতে সিদ্ধান্ত হল, কাল তারা বাড়ি ফিরে যাবে আতঙ্কে স্পষ্ট কোনো কথা বেরোচ্ছে না তাদের তিনজন একসঙ্গেই বাসে ওঠে এখন এই বুধবার সকালে বাসে বসেও গত সন্ধ্যার সেই ছবি তাদের পিছু ছাড়ছে না মাথার ভেতরের স্নায়ুগুলো কোন এক জটিল উদ্দীপনা সহ্য করতে না পেরে ফেটে যাওয়ার উপক্রম নামমাত্র চোখ বন্ধ ঘুম আসছে না চোখের সামনে শুধু কাল সন্ধ্যার ধূসর কালো ছবি ভেসে আছে তাদের কাছে এইসব ঘটনা খুব অস্বাভাবিক নয় কিন্তু কলমডাঙার মতন জায়গাতেও এই অবস্থা! এটা মেনে নিতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে

 

ধরা যাক... 

কলমডাঙা থেকে কালিনগর যাওয়ার পথে প্রথম স্টপেজ খ-এর তারপর ক আর গ একই স্টপেজে বাস ছুটছে জানালা দিয়ে মাঝেমাঝে চোখ মেলে তারা দেখে গোটা রাস্তাটার পাশ জুড়ে একই তরজা একই উত্তেজনা সব মানুষ কেমন অপ্রকৃতিস্থ লাল লাল চোখ নিয়ে এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে পরিবর্তন বা বদলের ডাক মুখে নিয়ে নিজেরা নিজেদের অজান্তে বদলে যাচ্ছে এই প্রক্রিয়া এতটাই দ্রুত ঘটছে যে সেটা তাদের নিজেদের নজরে আসছে না ক খ গ তিনজনেই অস্ফুট উচ্চারণ করে— এসব জায়গাতেও!

ভেতর থেকে একটা ফোঁপানি গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে আটকে যায় তাদের আসলে কলমডাঙা থেকে যত কালিনগরের দিকে যাওয়া যায়, ততই নরম গ্রাম আর সতেজ রং জমাট বাঁধতে থাকে স্টপেজের যেখানে যেখানে বাস দাঁড়াচ্ছে সেখানেই একটা দু’পায়া ক্রসকাঠের টেবিলে সাজিয়ে মাংস বিক্রি হচ্ছে মানুষের মাংস প্রতিনিয়ত যেভাবে আমাদের লড়তে হচ্ছে, একটি সুস্থ সমাজ গড়ে তোলার জন্য, আমাদের শরীরের অনেক অংশে ক্ষত তৈরি হচ্ছে— সেই অংশগুলো বিভিন্ন মূল্যে আমাদের এখান থেকে সংগ্রহ করতে পারেন

বাসের ভেতর থেকে কেউ কেউ বেরিয়ে এসে সংগ্রহ করছে কেউ একটা তরল তাজা রক্তে ডোবানো হৃৎপিণ্ড, কেউ কানের লতি, বাহুর এক খাবলা মাংস নিয়ে বাসের ভেতর এসে বসল আর স্থির থাকতে পারছে না ক খ গ বাইরের এই পৃথিবীর সঙ্গে তারা কোনোভাবে নিজেদের মেলাতে পারছে না এই বাসের মধ্যে অনন্তকাল বসে থেকে যাওয়াই যেন নিরাপদ মনে হয় বাসের সিঁড়িগুলো যেন নেমে যাচ্ছে এক স্থির বিশ্বাসের দিকে যে বিশ্বাস হিংসা আর ঘাতকতার ছন্দে তাল মেলানো একটা নূপুর বাইরে বেরোলে এই হাঁটতে হবে এই নূপুর পরেই

 

ধরা যাক...

কিছুদূর যেতেই বাস থেমে গেল ঘোরের মধ্যে থেকেও তিন বন্ধু নাড়া খেয়ে উঠল বাসের হঠাৎ ঝাঁকুনিতে নিঃশব্দে তাদের ভাবনা সূত্র দুমড়েমুচড়ে গেল সামনের পথ অবরোধ করেছে কেউ অনেকগুলো মরা কুকুর ফেলে ঠ্যাং আকাশের দিকে মুখ থেকে তাজা রক্ত কান গড়িয়ে মাটিতে পড়ছে কেউ যেন বলে উঠল— এই বাধা না মানলে মরা মানুষের বাঁধ দেবে তারা পিচ্ছিল চামড়া পেরিয়ে বাসের চাকা এগোনো অসম্ভব

 

ধরা যাক...

কতক্ষণ পর বাস চলতে শুরু করেছিল, তারা জানে না খ বাস থেকে নেমে গেল অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিজের স্টপেজ ছাড়িয়ে অন্য কোনো মোড়ে ক আর গ বাসের সিঁড়িতে যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাথর হয়ে গেছে বাস ছেড়ে নামার কোনো লক্ষণ নেই তাদের স্টপেজ পেরিয়ে বাস ছুটছে স্নায়ু, ইন্দ্রিয় এখন অচল শেষ স্টপেজ আসার আগে অনেক কষ্টে গ নেমে পড়ে সিঁড়ির ধাপে তার চিটে যাওয়া পা শেষ মুহূর্তে তার সঙ্গে ছলনা করে ক ঠায় দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে অচেতন বাসের শেষ স্টপেজ এসে গেলেও সে নামে না দরজা থেকে ফিরে গিয়ে সে বসেছে একটা সিটে মুখচোখ নির্বিকার খালি বাসে সে এখন একা এই শান্তিই সে চেয়েছিল তার সারা মুখে একটু একটু করে স্বস্তির হাসি ফুটে উঠছে

 

1 comment:

  1. ভালো লাগল।বনমালী নামটা ছাড়াই ভালোলাগা।

    ReplyDelete