বাক্‌ ১৪৮ ।। রাহুল দাশগুপ্ত

 

এক অবিরাম স্বীকারোক্তি

 

 

কখনও কখনও মৃত্যুকে এড়ানো যায় না

সামনাসামনি দেখা হয়ে যায়

মাথা নিচু হয়ে আসে তখন

 

দুঃস্বপ্নের মতো যাকে ভেবেছিলাম

তাকে তখন খুব স্বাভাবিক লাগে

কুশল জানতে ইচ্ছে করে

 

মৃত্যু মানুষকে খাঁটি করে তোলে

তলস্তয়ের চরিত্র ইভান ইলিচের মতোই

চারপাশের সবাইকে তখন মঞ্চাভিনেতা মনে হয়

 

চারপাশে যেন যাত্রার উৎসব বসেছে

বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভাঁড়েদের দল

শুধু সেই মানুষকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসতে ইচ্ছে করে

তার কাছে ঋণস্বীকার করতে ইচ্ছে করে

 

সে জানে, তার হাতে সময় বেশি নেই

সে শান্তভাবে খবরটা জানায়, যেন মেনে নিয়েছে

তারপর তুষারপাতের মতোই নীরব হয়ে যায়

 

সে বহন করে চলে মৃত্যুকে

তার দিকে তাকালে তখন মাথা নিচু হয়ে আসে

উপাসনাগৃহ বা স্থাপত্যের দিকে তাকালে যেমন হয়...

 

১০

 

একটা সরল জীবন চাই

সরল আর অনাড়ম্বর

রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাব

   আর চারপাশের দৃশ্য দেখব

ভাত আর ডাল খাব

অথবা রুটি আর আলু ভাজা

আর তোমার মুখের দিকে তাকাব

     তোমার সাড়ে চার বছরের মুখ

 

আলোর এক চলমান বিগ্রহ তুমি

দুনিয়ার সমস্ত পাপকে তুচ্ছ করে

ছুটে চলেছো দিগন্ত থেকে দিগন্তে

   তোমাকে স্পর্শ করছে না কিছুই...

 

এক অপার্থিব সঙ্গীতের মতো

মাঠ, বন, পাহাড়, নদী, ঢেউ খেলানো উপত্যকা

নুড়িপাথর, ঝাউগাছ, তুষারপাত

  সমস্ত দৃশ্যের ভেতর তুমি আছো

 

এক চিরন্তন, শাশ্বত প্রাণের মতোই

আর ছবি এঁকে চলেছ

সমান্তরাল এক দুনিয়ার ছবি

যেখানে সবকিছুই সম্ভব

 

সেখানে তুচ্ছ হয়ে গেছে বাস্তবতা

সম্ভাব্যতা কেবলই রচনা করে চলেছে নিজেকে

শাদা পৃষ্ঠা নিমজ্জিত অলৌকিকতায়

   স্তব্ধতার ভিতর শুধু প্রার্থনাধ্বনি

 

একটা সরল জীবন চাই, অনাড়ম্বর

আমার সন্তানের মতো...

 

 

১১

 

পৃথিবীর সবথেকে ভালোমানুষেরা আজ বিপন্ন

আমি কী করতে পারি?

 

যখন সে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে

মহাকাব্যের কোনও চরিত্রের মতো

আমি তখন কী করতে পারি?

 

ভোগ নয়, ত্যাগের মন্ত্রেই সে কাটিয়েছে সারা জীবন

যার যেখানে বিপদ, ছুটে গেছে, সাধ্যমতো

                  উপকার করেছে

 

আজ তার বুকভরা অভিমান

চারপাশের শুন্যতা, নিঃসঙ্গতা, দুর্বলতা

খাট থেকে সে যদি টলে পড়ে যায়

                আমি কী করতে পারি?

 

সে কখনও কিছু লুকোয়নি, এত স্বচ্ছতা

কাচের মতো বা পাহাড়ি উপত্যকায় নদীর জলের মতো

সে যদি বহন করে চলে কোনও মহৎ বিয়োগান্ত নাটক

লুকোতে চায় তাকে, নিয়তির নির্মম পরিহাসের মতো, তখন

                                 আমি কী করতে পারি?

 

সেই অসামান্য বুদ্ধিমতী শিশুটি

                    তার অনুপস্থিতি

যখন বুঝিয়ে দেয় গভীর রাতে

সে কতটা জুড়ে আছে, ভরে আছে, পূর্ণ করে আছে

কী বিরাট তার ব্যাপ্তি, তার অস্থিরতা, তার বিস্তার

জীবনের প্রতিটি নিভৃতিকে ছুঁয়ে আছে আহ্লাদে

   তখন আমি, এক হতভাগ্য, কী করতে পারি?

 

১২

 

চলো, জীবনকে নিয়ে কিছুক্ষণ ঠাট্টা করা যাক

কিছুক্ষণ, তার বেশি নয়

কারণ জীবনকে নিয়ে বেশিক্ষণ ঠাট্টা করা যায় না!

 

আসলে জীবন একটা রহস্য

ওখানে কোনও ব্যাখ্যা চলে না

ওখানে কোনও প্রশ্ন করা যায় না

ওখানে উন্মোচন মানেই নিরন্তর ঝুঁকি

                প্রত্যাখ্যানের অতল খাদ

 

যে মানুষটা সবচেয়ে সৎ

জীবন তাকেই করে তোলে করুণার পাত্র

যে মানুষটা আগাগোড়া শৃঙ্খলায় থেকেছে

জীবন নিমেষে তাকে বিশৃঙ্খলায় ঠেলে দিতে পারে

 

তখন তার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়

ফিরে আসার পথ থাকে না

সে জীবনের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলে

                          অক্ষম নিরুপায়তায়

চলো, সেই জীবনকে নিয়ে ঠাট্টা করা যাক।

 

দ্যাখো, রাস্তাঘাটে, মঞ্চে আর যাত্রার আসরে

জাঁকিয়ে বসেছে একদল ভাঁড়

জীবন ওদের কান মুলে দিতে পারে না?

পারে না ওদের নরকের আগুনে পুড়িয়ে মারতে?

 

একদল স্কাউড্রেলের গায়ে আঁচড়টি লাগবে না

কামুক, ভণ্ড, মিথ্যেবাদী, প্রতারক আর সুবিধাবাদীরা

নায়ক-নায়িকা সেজে দিব্যি বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে

আর সমঝোতা করে নেবে জীবনের সঙ্গে?

 

এই আপোশ-সমঝোতা-বোঝাপড়া দেখলে শুধু

                                  ঠাট্টা আসে

চলো, জীবনকে নিয়ে কিছুক্ষণ ঠাট্টা করা যাক

কিছুক্ষণ, তারপর আবার মনোযোগী হতে হবে

                                আর উদাসীনও

কারণ জীবনকে নিয়ে বেশীক্ষণ ঠাট্টা করা যায় না!

 

১৩

 

যদি ঘেন্না আসে, বিশুদ্ধ ঘেন্না

যদি প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করে,

                      হাতে চাবুক নিয়ে

নিয়তির দুর্ভেদ্য প্রাচীরের সামনে দাঁড়িয়ে

যদি চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হয়

আর্তনাদ

যদি মনে পড়ে একের পর এক স্মৃতি

ভালোমানুষদের সমাধি

যন্ত্রণাকাতর অশ্রুভেজা চোখ

অকপট স্বীকারোক্তি

জীবনকে আয়না ভেবে মুখোমুখি হওয়ার

                                সততা

 

আর তারপর দুঃস্বপ্নের থাবায়

হাসপাতালের দুর্গন্ধে

দুর্নীতির ও অজ্ঞানতার স্পর্ধায়

ধূর্ত পাপীদের দ্বিচারিতায়

              বিপন্নতার দিনলিপি

নিয়তির দুর্ভেদ্য প্রাচীরের সামনে দাঁড়িয়ে

তখন টলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে সেই প্রাচীর

খসিয়ে দিতে ইচ্ছে করে

            একটার পর একটা পাথর

আর তারপর প্রতিটা পাথর তুলে

ছুঁড়ে মারতে ইচ্ছে করে

সভ্যতার ড্রয়িংরুমের কাচের দেওয়ালের দিকে...

 

 

 

 

 

 

 


1 comment:

  1. রাহুলদার কবিতা 'এক অবিরাম স্বীকারোক্তি' আসলে কনফেশন ধর্মী কবিতা।মৃত্যু আসলে দুঃস্বপ্ন যার সাথে আমাদের দেখা হয় প্রতিক্ষণে।চলে কুশল বিনিময়।নিজের উপাসনাগৃহের মতো একটা সরল জীবনরেখা খুঁজতে চান কবি।পৃথিবীর সমস্ত ভালো মানুষদের বিপন্নতা কবিকে ক্লান্ত করে,পীড়া দেয়।তাদের জন্য কিছু করতে না পারার হতাশা ভিতরে ভিতরে কাজ করে।শ্লেষ বর্ষিত হয়েছে কবিতায় যেখানে জীবন তো আসলে ঠাট্টারই মতো।জীবনের প্রতি যাবতীয় ঘেন্না থেকে প্রতিবাদে মুখর হন কবি।বস্তাপচা সিস্টেমটা ভেঙে দেওঢ়ার জন্য হাতে তুলে নেন প্রস্রর কলম।খুব সুন্দর কবিতা।

    ReplyDelete