দারু
ঘুমটা আচমকা ফেটে গেল। তারপর ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। অনেকটা
অসতর্কে হাত থেকে পড়ে যাওয়া ডিমের মতো। চোখজোড়া হয়ে উঠল জোড়া কুসুম। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা যাকে বলে। সেই মতো তাকিয়ে
থাকলাম ঘরের চারপাশে। চোখের পাতা পড়ে না। নড়ে
না। চড়ে না। পাতাগুলো সব যেন উবে গেছে মুহূর্তে!
এইরকমটা মনে হল আমার।
তারপর আরও মনে হল, দেখলাম বাবা ধস্ত দেয়ালের ধূসর ছবির ফ্রেমের মধ্যে থেকে
আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। আর মিটিমিটি হাসছেন। আরও স্পষ্ট দেখলাম, বাবার চোখের
পাতা স্বাভাবিক ভাবে মানুষের মতো নড়াচড়া করছে। মানে উপরনীচ করছে।
একটু আগে যেমন আমার করত।
এ কী করে সম্ভব! ‘বিস্ময়’ নামক শব্দটা আমার
দু’চোখের ওপর সাইনবোর্ড হয়ে ড্যাংড্যাং করে ঝুলতে লাগল। প্রবলভাবে দুলতে লাগল।
বাবা বোধহয় আমাকে কিছু বলবেন! নির্ঘাত কিছু
বলবেন। ঠোঁট নড়ছে। বিড়বিড় করছেন। বহু বছর কিছু বলেননি।
বেঁচে থাকতে অনেক ভালো ভালো কথা বলতেন। তখন পাত্তা দিতাম না। পাশ কাটিয়ে যেতাম। মনে হত, জ্ঞান
দিচ্ছেন।
এখন আপশোশ হয়। ভীষণ আপশোশ হয়। হয়তো তেমন
তেমন অনেক কথা তাঁর মনের মধ্যে এখনও জমে আছে দীর্ঘদিন যাবত। কাউকে বলতে পারছেন না। বোঝাতে পারছেন না। হয়তো আমাকে বলবেন সেসব...
কী কথা? কী ভাবনা থেকে ওইসব কথার সূত্রপাত? আমি
জানি না। তবুও আগ্রহ প্রকাশ করে জিগ্যেস
করলাম, কিছু বলবে আমায়?
বাবা কোনও উত্তর দিলেন না। পিটপিট করে আমার
দিকে আগের মতো তাকিয়ে রইলেন। চোখের
পাতা ওপরনীচ করছে অনবরত। হাসছেন। অনেকটা মায়াময়
নির্ভেজাল সেই হাসি। সেই হাসি ফেটে যাওয়া বালিশের তুলোর মতো আমার সারা শরীরে ছড়িয়ে
পড়ছে নিমেষে। ভালো লাগছে। ভীষণ ভালো লাগছে। রাশি
রাশি আনন্দ। রাশি রাশি প্রশান্তি আমার শরীর ঘিরে। এমন ভালোলাগা কাউকে বলতে করতে পারছি না। এমনকি মাকেও!
বাবার সেই হাসি দেখতে দেখতে আমি লোভ সামলাতে
পারলাম না। অনেক দিন পর, অনেক মাস পর, অনেক বছর পর আবার বাবাকে কাছে পেলাম
ক্ষণিকের জন্য। মা-ও জানতে পারল না। তাই সরাসরি জিগ্যেস
করলাম, কী দেখছ অমন করে?
আগের মতো বাবা অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
নির্ঘাত আমায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। মাথা
থেকে পা পর্যন্ত। যেমনভাবে আগে দেখতেন। ঠিক সেইভাবে। তারপর বাবা একটা বড়রকমের
শ্বাস ফেলে হাসিমুখে বললেন, তোকে।
কেন? আমার মধ্যে কোনও পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছ
নাকি! আমি আগ্রহ ভরে জিগ্যেস করলাম।
পাচ্ছি রে। পাচ্ছি। খুব পাচ্ছি।
কীরকম?
তা তো বলতে পারব না।
এবার বাবা খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। অনেকক্ষণ
চুপ করে রইলেন। তারপর ফ্যাশফেশে গলায় বললেন, মাকে জিগ্যেস কর।
বাবার এই কথা আমার পছন্দ হল না। একটু যেন
অভিমান হল বাবার প্রতি। আর হাসিটাও বাবার মুখে দেখতে পেলাম না। সব কেমন ভুস হয়ে
গেল। আগের মতো গম্ভীর আর নিশ্চুপ। ধূসর হয়ে
গেলেন ছবির ফ্রেমে। ভাঙাচোরা লাট খেয়ে যাওয়া ষাট বছরের পুরোনো ঘরের দেয়াল থেকে
একটা অদ্ভুত পচা গন্ধ ভুরভুর করে বেরুতে লাগল। আগে এই গন্ধটা পেতাম না। এখন
প্রবলভাবে পাচ্ছি। বাবার মতো বাড়ির দেয়ালগুলো যে একটু একটু করে মরে যাচ্ছে তা আমি
স্পষ্ট টের পাচ্ছি। প্রতিদিন ইট, বালি, সিমেন্ট ঘরের মেঝেতে ছাইয়ের মতো পড়ে থাকে।
আমি যেমন দেখছি। তেমন মা-ও। মা প্রতিদিন নিয়ম করে ঝাঁট দেন। তারপর সেই ছাইগুলো
কাগজের নৌকো করে বাইরে ফেলে দেন।
বিছানা থেকে নামলাম। বাবার ছবির ওপর হাত
বোলাতে লাগলাম। অনেক অজানা ধুলো জমে আছে বাবার ছবির ওপর। আমার হাতের তালু,
আঙুলগুলো এলোমেলো জলছবি হয়ে গেল মুহূর্তে। খুব কষ্ট হতে লাগল। ডানহাতের তালু নাকের
কাছে নিয়ে এলাম। বাবার গায়ের গন্ধ খুঁজে পেলাম না একটুও। বরং আরও তীব্রভাবে এক অদ্ভুত পচা গন্ধ নাকে ঝাপটা মারতে লাগল। নাকের ভিতরটা
জ্বলতে শুরু করল। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, সেই জ্বলনটা একটু একটু করে আমার রক্তের
সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। আমার শরীরের ভিতর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঙ্গে ভীষণভাবে ধাক্কা
মারছে।
২
পাশের ঘরে গেলাম। দেখলাম মা ঘরের দেবতাদের চান করাচ্ছেন। আমি যে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছি, একটুও
খেয়াল নেই। একমনে বারবার দেবতাদের মাথায় জল ঢেলে যাচ্ছেন। দেবতাদের শরীর ঠাণ্ডা
হচ্ছে সেই জলে। হঠাৎ মা আমাকে দেখে হেসে ওঠেন।
তুমি হাসছ!
হ্যাঁ। হাসছি। তোকে দেখে হাসছি।
আমি ব্যাকুলভাবে জিগ্যেস করি, কেন তুমি হাসছ?
বললাম তো তোকে দেখে।
আমাকে দেখে তোমার হাসি পাচ্ছে?
হ্যাঁ।
তালে বাবা ঠিকই বলেছে।
কী বলেছে তোর বাবা?
আমাকে নাকি অন্যরকম দেখাচ্ছে।
তা বলতে পারব না বাপু। বলেই মা আবার
দেবতাদের মাথায় জল ঢালেন। জল ঢেলে চলেন একমনে। কোনওদিকে তাঁর কোনও দৃষ্টি নেই।
একটু পরে ফুল দেবেন চরণে। কারওর গলায় মালা পরিয়ে দেবেন। প্রত্যেকের থালায় মিষ্টি
সাজিয়ে দেবেন। খাবার জল দেবেন। দেবতারা খাবেন কিনা জানি না। জানতেও চাই না। জ্ঞান
হতেই মাকে এই আয়োজন করতে দেখছি। এখনও দেখে চলেছি।
আমাদের বাড়িটা যত দিন যাচ্ছে একটু একটু করে
মাটির তলায় দেবে যাচ্ছে। আশপাশের রাস্তা উঁচু হয়ে উঠছে। শুধু আমাদের বাড়ি নয়।
আশেপাশের অনেকের বাড়ি। একটু বৃষ্টি হলেই সমস্ত নোংরা জল বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ে। মা তখন মাছ হয়ে ওঠেন। হাতের আঙুলগুলো মাছের পাখনার মতো সাদা
আর ফ্যাকাসে হয়ে যায় মুহূর্তে। মাঝেমধ্যে
মায়ের রাগ আমার শরীরে এসে ঝাপটা মারে। আমি
পুড়তে থাকি। কাউকে কিছু বলতে পারি না।
এই রাস্তা দিয়ে অনেক মানুষ যাতায়াত করে।
সবাই দেখে। দেখে আমরা মাছের মতো কিলবিল করছি একটা চৌকো গামলার ভিতর। আমার বন্ধুরা বাইক নিয়ে আসে। আমায় ডাকে, অ্যাই ঝিলম কী
করছিস?
দেখছিস তো মায়ের সঙ্গে ঘরের নোংরা জল
পরিষ্কার করছি।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি।
মাসিমাকে তো দেখতে পাচ্ছি না। মাসিমা কোথায়?
লিটন জিগ্যেস করে।
কোথায় আবার? ঘরে!
আমরা কেন দেখতে পাচ্ছি না!
মা এই ঘরেই আছে রে। আমি হাসতে হাসতে বলি, মা, এই মুহূর্তে মাছ হয়ে গেছে! এই কালো নোংরা জলে ডুবে
আছে। তোরা দেখতে পাবি না...
তোর মাথাটা একেবারে গেছে। লিটন বলে, আজ রাতে
চলে আসিস ক্লাবে। দারুর আসর বসবে। খরচা ক্লাবের।
৩
এখন বৃষ্টি নেই। কিন্তু ঘরের দোরে ফুট দুয়েক পাঁচিল রয়ে
গেছে। মা কোনওদিন এই পাঁচিল টপকে বাইরে আসেননি। একমাত্র আমিই জানি, বাবা চলে
যাওয়ার পর মা যে সেই মাছ হয়ে গেছে, তা আর পরিবর্তন হয়নি। এই চৌকো গামলার ভিতর
বাতাসে ভাসেন। ভাসতে ভাসতে ঘরের সাতকাজ করেন। কখনও বা বৃষ্টির জলে সাঁতার কাটেন। আর ওইটুকু সময় আমিও মায়ের সঙ্গে থাকতে থাকতে মাছ হয়ে উঠি। মা জানেন সেটা। মা তখন খুশি হন। আমার
ওপর রাগটা তখন গিয়ে পড়ে বাবার ওপর। বাবা জানতেও পারেন না।
তখন আমার মনে হয়, এ পাড়ার অনেকেই আমাদের মতো
মাছ হয়ে বেঁচে আছে। দীর্ঘদিন। দীর্ঘকাল। আমাদের মতো কেউ ভাবতে পারছে না। কেউ কিছু
বলতে পারছে না। সবটাই যেন কপালের ফেরে মেনে নিয়েছে। তাই মাছ হয়ে থাকাটাই বুঝি আমাদের ভবিতব্য!
আমি ক্লাবে যাই। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারি।
দারু খাই। চাট হিসেবে বটার কড়া ঝাল। মুখের ভিতর পচা বিস্বাদটা নিমেষে পালটে যায়।
নতুন ভাবে বাঁচতে ইচ্ছা করে...
তারপর গভীর রাতে বাড়ি ফিরি। মা কিছু বলে না।
মরা মাছের মতো তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। তারপর বলে, আয়, খাবি আয়। অনেক রাত হল।
খাওয়া শেষ হলে মাকে ডাকি। মা কোনও সাড়া দেয় না। আমি জানি, এই সময় মা শুয়ে আছেন
বিছানায় একরাশ অন্ধকার গায়ে মেখে। চোখের পাতা পড়ে না। মা যে অনেক দিন আগে থেকে মাছ
হয়ে গেছেন বাবাও জানল না।
আমার কী তাই পরিণতি হবে! আমার চোখের পাতা
পড়ছে না। আমি আবার নিজের ঘরে ফিরে আসি। ছোট্ট পারা চটে যাওয়া আয়নায় নিজেকে দেখি।
বারবার। আর অবাক হয়ে যাই। ঘুম ফেটে যাওয়ার পর থেকে এখনও অবধি দুই চোখের পাতা
পড়েনি। আমি তাহলে মায়ের মতো...
৪
একছুটে আবার মায়ের কাছে গেলাম। আমার ভয় হতে লাগল। ভয়ের
কথাটা বলতে পারলাম না মাকে। আরও
আশ্চর্য হলাম, এখন দেবতাগুলো জলের মধ্যে মাথা তুলে সটান দাঁড়িয়ে আছে। যেন একটু
একটু করে বড় হচ্ছে আমাদের চোখের সামনে।
এইরকমই মনে হতে লাগল।
আমি উপুড় হয়ে বাতাসে ভাসতে ভাসতে জিগ্যেস
করি, মা, তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ তো?
হ্যাঁ রে পাচ্ছি খোকা। মা হাসতে হাসতে বললেন, তোর বাবা ঠিকই বলেছে, তোকে অন্যরকম দেখতে লাগছে।
কীরকম?
তোর চোখজোড়া যে অ্যাতো বড়, আগে কোনওদিন এমন
করে দেখিনি। তুই আমার একমাত্র ছেলে। সামনের দোসরা ডিসেম্বরে তিরিশ বছর বয়স হবে তোর...
আমি মায়ের কোনও কথা শুনতে পাচ্ছি না। বার
বার বলি, মা, আমি তোমার দেবতাদের মতো চান করব।
বেশ তো। আয় চলে আয়।
আমার তিরিশ বছরের শরীরটা মুহূর্তে তিন ইঞ্চি
হয়ে যায়। দেবতারা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে মাকে। আমাকে। গামলার জলে মাছের মতো পুড়ুক
পুড়ুক করে সাঁতার কাটি। মা খুব খুশি হয়। ছেলেমানুষের
মতো হাততালি দিয়ে ওঠেন।
আমি জলের খুব গভীরে চলে যাই। দম বন্ধ হয়ে যায় আমার। আমি কিছুতেই নিশ্বাস নিতে পারছি না। কিছুতেই
না। তবুও আমি মায়ের কানের কাছে মুখ এনে ফিশফিশ করে বলি, তুমি অ্যাতোদিন শুধুমুধু
মৃত দেবতাদের পুজো করে চলেছ...
তাই নাকি!
হ্যাঁ, মা।
আমার কথা বিশ্বাস হয় না মায়ের। আয়, কাছে আয়।
বলতে বলতে মা আমায় কোলে নিয়ে গামলার মধ্যে উঠে বসেন। চারদিকে তাকান। মায়ের অনেক আগেই আমার মতো চোখের পাতা পড়ে না। মাথার ওপর এই
ছাদটাকে মনে হয় বিশাল জাল। জালটা ক্রমাগত বিস্তার হচ্ছে একের পর এক। গ্রাম। পাড়া।
শহরে।
৫
তারপর এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে গেল একটু একটু করে। দেবতারা আমাদের শরীরের ওপর পা রেখে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে বাইরে পা রাখলেন।
বাইরে তখন শুনতে পাই হইহই আনন্দ। উদ্দাম
নৃত্য। স্লোগানের তুবড়িতে আকাশবাতাস মুখরিত। উৎসবের পরিমণ্ডলে পাড়া কাঁপিয়ে ছুটে চলছে একের
পর এক মোটরবাইক। ক্লাবে বসেছে দারুর আসর।
একটু পরে আমিও যাব। দারু খাব। দারু...
No comments:
Post a Comment