বাক্‌ ১৪৮ ।। হৃষীকেশ বাগচী

ভোগী

 

[ঐতিহাসিকেরা মনে করেন আজ যেখানে নীলাচল পাহাড়ের ওপর কামাক্ষ্যা দেবীর মন্দির আগে সেখানে নরবলি হত। পরে তা বন্ধ হয়। কিন্তু তার পরেও একশ্রেণির মানুষ স্বেচ্ছায় আত্মাহুতি দেবার জন্য রাজার কাছে নাম নথিভূক্ত করতেন। এদের বলা হত ‘ভোগী’এক বছর বিলাস ও ব্যাভিচারে লিপ্ত রেখে বছর শেষে তাদের বলি দেওয়া হত। এইটুকুই গোপন ইতিহাস। বাকিটা গল্প।]

 

(১)

রাস্তা দিয়ে সুদৃশ্য মিছিল চলেছে। রাস্তার ধারে অনেকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দুই যুবক তাই দেখছে। একজনের নাম শীলভদ্র। সুদর্শন। সুঠাম শরীর। হাতদুটো বলিষ্ঠ। তবে চোখদুটোতে শিল্পীর কমনীয়তা ও স্বপ্নময়তা আছে। পাশে তার বন্ধু বিরূপাক্ষ।

মিছিলের পুরোভাগে রত্নখচিত হাতির পিঠে হাওদায় বসে চলেছেন মহারাজা নরনারায়ণ। তাঁর সামনে পেছনে পদাতিক ও ঘোড়সওয়ার। এরা রাজার দেহরক্ষী। তাঁর পেছনে পায়ে হেঁটে চলেছেন রাজপুরোহিত ও তাঁর অনুচরেরা। গায়ে পট্টবস্ত্র ও পৈতে। তাদের পেছনে পাঁচজন ভোগী। এরা চলেছে ঘোড়ার পিঠে। সকলেই ঝিমোচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে তারা মাদকের প্রভাবে আচ্ছন্ন। এরাই আজকের মিছিলের প্রধান আকর্ষণএদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মহাকালী কামাক্ষ্যা দেবীর মন্দিরে বলির উদ্দেশ্যে।

সবার পেছনে চলেছে রাজঅন্তঃপুরের নারীরা। তাদের মধ্যে রয়েছেন রাজার একমাত্র কন্যা চন্দ্রাবতী। সে যুবতিবারবার উৎসুক চোখে বাইরের ভিড় দেখছে পালকির পর্দা ফাঁক করে।

পরনে নীল রঙের রেশমের কাপড়। দেহ গয়নায় সুসজ্জিত। যুবকদের সামনে পালকি এলে শীলভদ্রের সঙ্গে চন্দ্রাবতীর চোখাচোখি হয়ে গেল। দু’জনের দৃষ্টি আটকে রইল যতক্ষণ না পালকিটি দৃষ্টিপথের আড়ালে চলে যায়। বিরূপাক্ষ শীলভদ্রের হাতে জোরে একটা চিমটি কাটলে তার সংবিৎ ফিরল।

—আকাশের চাঁদকে দূর থেকে দেখাই ভাল। কাছে গেলে তার তেজও পুড়িয়ে দিতে পারে। বিরূপাক্ষ বলল।

—তবুও যখন দীঘির জলে তার ছায়া পড়ে, জ্যোৎস্না এসে গায়ে লাগে তাকে যে বড়ই কাছের কেউ বলে মনে হয় বন্ধু

—হুম্‌ ভোগীদের দেখলে?

—ফি বছর এই জঘন্য, নৃশংস প্রথা দেখে দেখে আমার ঘেন্না ধরে গেছে। এর কি শেষ হবে না কোনোদিন?

—মিছিলের পুরোভাগের রাজপুরোহিত তো তোমারই বাবা। তিনি চাইলে অনেক কিছুই পারেন।

—বাবা ভক্তি ও সংস্কারে অন্ধ হয়ে গেছেন। আমি অনেক চেষ্টাতেও তাঁর বিশ্বাসকে টলাতে পারিনি।

—কিন্তু মহারাজ নরনারায়ণ, তাঁর কী অভিরুচি?

—রাজা প্রজাপালক। তিনি তাই চান প্রজারা যা চায়।

—তোমার কি মনে হয় প্রজারা চায় যে এই কুপ্রথা চলুক?

—প্রজারা বেশিরভাগই অশিক্ষিত, দরিদ্রতারা পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যে বিশ্বাস করে।

—ওরা কী বিশ্বাস করে? কী সেই ঐতিহ্য?

—ওরা বিশ্বাস করে মা মহাকালীকে কেবল মানুষের রক্ত দিয়েই তুষ্ট করা যায়। মা রক্তপায়ী। তিনি খুশি হলেই জমিতে ফসল ভরে উঠবে। আমাদের অহোম সাম্রাজ্যের জমি ধানে ধানে ভরে যাবে। আর তাকে খুশি না করলেই বিপদ। বন্যা খরা আর মহামারীতে দেশ উজাড় হয়ে যাবে।

—সে তো বুঝি। তবে আমার আশ্চর্য লাগে যে প্রতিবছর পাঁচজন করে ভোগী জোগাড় করতেও কি কোনো অসুবিধে হয় না? আমি তো শুনেছি সবাই নাকি স্বেচ্ছায় ভোগী হতে চায়। মানুষের কি মৃত্যুভয় নেই?

—সবাই যে পুণ্যের কথা ভেবে ভোগী হতে চায় সেটা বাজে কথা। যাদের বেঁচে থাকাই দুর্বিষহ তারা নিজেদের জীবন দিয়ে তাদের পরিবারের লোকেদের ভালো থাকার উপায় করে দিয়ে যায়। যারা কামুক তারা এক বছর ধরে নিজেদের লোভ ও কাম পুরোপুরি চরিতার্থ করে নেয়।

—তবে অনেককেই ভয় দেখিয়ে ভোগী হতে রাজি করানো হয় এমনটাও আমি শুনেছি।

—আমিও তা শুনেছি। তবে বাবা তেমন কিছু স্বীকার করেন না।

মিছিল চোখের আড়ালে চলে যেতেই ভিড় পাতলা হয়ে যায়। নাগরিকেরা মিছিলের পেছন পেছন দেবীমন্দিরের কাছে বধ্যভূমির দিকে ‘জয়, মা মহাকালীর জয়’ এই হর্ষধ্বনি দিতে দিতে এগিয়ে যায়। দুই যুবক তাদের বাড়ির দিকে ফিরে চলে।

—বিরূপাক্ষ তুমি কি বাড়ি যাবে?

—সেইরকমই তো ইচ্ছা আছে। তুমি কী করবে?

—আমি একটু গুরুদেবের সাথে দেখা করে আসি। মনটা আজ বড়ই অস্থির লাগছে। বাড়ি গিয়ে কাজে মন বসাতে পারব না। গুরুদেবের শান্ত মুখ দেখলে মনে স্থিরতা আসে।

—বেশ তাহলে চলো, আমিও যাই।

দুই যুবক অহোম রাজ্যের শ্রেষ্ঠ ভাস্কর বিল্বদলের বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। বিল্বদল রাজার প্রধান ভাস্কর। এই দেশের যে কয়টি ভাস্কর্য রাজদরবারে শোভা পাচ্ছে সেগুলো তারই হাতে তৈরি। প্রাসাদ থেকে শুরু করে নগরতোরণের নকশা সবই তার নিজের হাতে বানানো। কিন্তু শিল্পী এখন বৃদ্ধ। ভাস্কর্যের মতো পরিশ্রমের কাজ তিনি এখন আর একা পেরে ওঠেন না। তিনি সারাজীবন অনেক শিল্পীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করেছেন। কিন্তু এই দুই যুবক অতি অল্প বয়সেই সবাইকে অতিক্রম করে গেছে।

এদের মধ্যে অমূল্য রত্নটি হল রাজপুরোহিত কালভৈরবের ছোট ছেলে শীলভদ্র। বিল্বদল এই ছেলেটিকে নিজের প্রাণের থেকেও বেশি ভালোবাসেন। তাঁর অবর্তমানে শীলভদ্রই যে তাঁর জায়গা নেবে মনে মনে তিনি সেটাই আশা করেন। রাজাকে নিজের মনের ইচ্ছেও তিনি জানিয়েছেন।

দুই যুবক যখন তাঁর বাড়ির দিকে আসছিল বিল্বদল খিড়কি দিয়ে তা লক্ষ করছিলেন। তিনি শয্যা থেকে উঠে বসার ঘরে তাদের প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। পাঁচ বছর আগে স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে তিনি একাই থাকেন। নিঃসন্তান বৃদ্ধের শিষ্য ও ভৃত্যরাই তাই সব সময়ের সঙ্গী। শিষ্যদের আগমনে তাঁর বিরক্তি আসে না। তাঁর মন প্রফুল্ল হয়। একাকীত্ব দূর হয়।

দুই বন্ধু ঘরে ঢুকে তাঁকে প্রণাম করল।

—আপনি এখনও এই ঘরে গুরুদেব?

—তোমাদের আসতে দেখেই আমি শয্যা থেকে উঠে এলাম। সারাদিন শুয়ে থাকতে আর ভালো লাগে না।

—আমরা মনে হয় আপনাকে বিরক্ত করলাম।

—একেবারেই না শীলভদ্র। তোমাদের সঙ্গ আমাকে শান্তি ও আনন্দ দেয়। তবে এই সময় তোমাদের আগমনে আমি যে অবাক হয়েছি এ কথা স্বীকার না করে পারছি না।

—আমরা গেছিলাম ভোগীদের মিছিলে। মনটা বিষন্ন হয়ে গেল। তাই আপনার কাছে এলাম শান্তির আশায়। এই কুপ্রথা কি বন্ধ করা যায় না গুরুদেব?

—রাজদরবারে রাজার অমাত্যদের মধ্যে একদল ক্ষমতাশালী আছেন যারা চান না এটা বন্ধ হোকতাদের নিশ্চই কিছু স্বার্থ এতে জড়িয়ে আছেস্বীকার না করে উপায় নেই তোমার বাবাকেও তারা হাত করে নিয়েছে। যদিও কালভৈরব নিজেই নিজের কুসংস্কারের বন্দি

—কিন্তু রাজার অমাত্যদের এতে কী লাভ থাকতে পারে?

—মাছ কখন জল খায় আর রাজপুরুষ কখন ঘুষ খায় সেটা কেউ বলতে পারে না। প্রতি বছর এই মহাকালীর পুজো ও বলি উপলক্ষ্যে রাজকোষ থেকে যে বিপুল অর্থের অনুমোদন হয় যার মধ্যে এক বছর ধরে পাঁচজন ভোগীর সেবাযত্ন থেকে শুরু তাদের পরিবারকে সাহায্য করা সবই আছে। এছাড়াও আজ থেকে শুরু হওয়া আগামী একমাস ধরে চলা বিঁহুর উৎসব তো আছেই। এই টাকা অনেক লোকের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা হয়। আমরা সবাই যারা রাজদরবারের খবর কিছু কিছু রাখি, তারা সবাই এই কথা জানি।

শীলভদ্র মাথা নীচু করে থাকে। বিল্বদল তাকে লক্ষ্য করে বললেন, শীলভদ্র, আমি তোমার বাবার সম্পর্কে কিছু বলছি না। আমরা সবাই জানি সে সাত্ত্বিক, ধার্মিক লোক। বাঁটোয়ারার টাকা তার কাছে পৌঁছুবার আগেই সে আত্মহত্যা করবে। তবে কালি দুর্বলচিত্ত। এই অন্যায়কে নিবৃত্ত করার সাহস তার নেই। অথচ সে যে এসব জানে না এটা আমি বিশ্বাস করি না।

—আমার পিতা খুব প্রাচীনপন্থী আর ভীতু। তিনি মনে করেন এই প্রথা বন্ধ হলে রাজ্যে বিপর্যয় এলে তার দায় তখন তাঁর নিজের আর আমাদের পরিবারের ওপর এসে পড়বে। রাজরোষ থেকে রেহাই পেলেও জনরোষ থেকে তখন পরিবারকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়বে।

—উনি পিতা ও বাড়ির প্রধান হিসেবে ঠিকই ভেবেছেন। ওনার জায়গায় আমি থাকলেও একই সিদ্ধান্ত নিতাম। মহারাজা নরনারায়ণ ছাড়া এই প্রথা বন্ধ করার ক্ষমতা আর কারওর নেই। কোনোদিন মহারাজকেই সবদিক বজায় রেখে এর বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অবশ্য সত্যিই তিনি যদি সেটা চান।

—মহারাজের মনের খবর কি আপনি রাখেন গুরুদেব?

—একেবারেই নয়। আমি সামান্য শিল্পী। রাজার অনুগ্রহে আমার সংসার চলে। রাজনীতির জগতে প্রবেশের অধিকার আমার নেই।

—কাউকে না কাউকে তো কিছু একটা করতেই হবেসবাইকে তো আর হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না।

—তোমরা যুবক। তোমরাই এখন এই অহোম রাজ্যের মুখ। তোমাদের হাতেই এর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।

দুই যুবক চুপ করে থাকে। কোনো জবাব দেয় না।

—ও আচ্ছা শীলভদ্র, তোমাকে একটা কথা বলার ছিল। কথায় কথায় ভুলেই গেছিলাম। বয়সের এই দোষ। স্মৃতিলোপ কিছুতেই সঙ্গ ছাড়ে না।

—বলুন গুরুদেব।

—মহারাজ আগামী বছর তাঁর বিশ বছর পূর্ণ হওয়া উপলক্ষ্যে এক বর্ষব্যাপী উৎসবের আয়োজন করতে চলেছেন। ওটি শুরু হবে এই মাসেই বিঁহু উৎসবের সাথে সাথে। রাজা চান সেই উপলক্ষ্যে তাঁর শ্বেতপাথরের এক মর্মর মূর্তি তৈরি করতে। তিনি চাইছেন সেই কাজটা আমি করি।

—বাহ্‌, সে তো খুব ভালো খবর। দুইজনেই সোৎসাহে বলে ওঠে।

—কিন্তু তোমরা তো জানো আমার শরীরের যা অবস্থা তাতে এই অল্প সময়ে অত বড় কাজ করা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।

—আমরা তো রয়েছি আপনাকে সাহায্য করার জন্য।

—তবু সম্ভব নয়। আর আমি চাই আমার হয়ে শীলভদ্র তুমি এই কাজটা করোমহারাজকে আমি আমার ইচ্ছের কথা জানিয়েছি। তিনি নিমরাজি হলেও অসম্মত হননি। শীলভদ্রের কী ইচ্ছা?

—আপনি তো জানেন গুরুদেব আপনি আমাকে কোনো কাজের ভার দিলে আমি নিজের জীবন বাজি রেখেও সেই কাজ করতে পারি। তবে আমি ভাবছি আপনি আমাকে যে কাজের ভার দিলেন এই মুহূর্তে সেই গুরুভার গ্রহণ করার মতো যোগ্যতা আমার আছে কিনা।

—তুমি ছাড়া এই অহোম রাজ্যে এই কাজের জন্য যোগ্যতর আর কে আছে শীলভদ্র? বিরূপাক্ষ বলল।

বিরূপাক্ষ এই কথাটা বলল বটে কিন্তু তার মুখের রেখায় একটা বেদনা প্রচ্ছন্ন হয়ে রইল। বাকি দু’জনেই সেটা লক্ষ করলেন এবং তাদের মনেও দুঃখের অনুভূতি হলতারা কেউ সেটা প্রকাশ করলেন না।

 

(২)

অহোম শান্তিপূর্ণ রাজ্য। তবে মাঝেমাঝেই বিভিন্ন আদিম জনজাতি সীমানা সংলগ্ন প্রত্যন্ত গ্রামগুলিকে আক্রমণ করে। অনেক সময় তারা গ্রাম থেকে লোক তুলে নিয়ে গিয়ে বলি দেয় বা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। রাজা নরনারায়ণ সীমান্তে সীমান্তচৌকি স্থাপন করেছেন। তবুও অনেক ক্ষেত্রে বর্বর জনজাতিদের গেরিলা আক্রমণ ঠেকানো অসম্ভব হয়ে পড়ে।

ইদানীং সেই অসভ্য জনজাতিদের একটি দল রাজধানীর উপকণ্ঠে কয়েকটি গ্রাম আক্রমণ করে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছে। রাজা সেনাপতির সঙ্গে এই দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। বর্বরদের বিরুদ্ধে সীমান্তে যুদ্ধ ঘোষণার ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে।

রণনীতি ও আর্থিক হাল খতিয়ে দেখতে তিনি আমলাদের নিয়ে ঘনঘন বৈঠক করছেন। এদিকে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তাঁর রাজত্বের কুড়ি বছর পূর্তির উৎসব উদ্‌যাপন হবে। অন্য রাজ্যের রাজাদের কাছে নিমন্ত্রণপত্রও পাঠানো হয়ে গেছে। তাই তিনি চান না আগামী বছর দেশে কোনো অস্থিরতা সৃষ্টি হোক। যেভাবেই হোক সীমান্ত সমস্যা এই বছরেই মিটিয়ে ফেলতে হবে।

মহারাজ তাই শীলভদ্রকে এক হপ্তার বেশি সময় দিতে পারবেন না। প্রতিদিন বড়জোর মিনিট পনেরো সময় তিনি তরুণ ভাস্করকে দিতে পারবেন। বাদবাকি কাজ রাজার উদ্যানে যে প্রমোদভবন আছে সেখানে গিয়ে তাকে শেষ করতে হবে। শীলভদ্র সবচেয়ে কঠিন কাজটাই আগে করে নিল। মূর্তি নির্মাণের জন্য যে মার্বেল আনা হয়েছে তাদের মধ্যে থেকে সঠিক মার্বেল নির্বাচন করার কাজ শুরু করে দিল। মার্বেল এসছে পশ্চিমের দেশ থেকে। অহোম রাজ্যের যত ভাস্কর্য সবার মার্বেল ওই দেশ থেকেই আসে।

মার্বেল নির্বাচনের পর মহারাজ তার সময় অনুযায়ী কিছুটা সময় শীলভদ্রকে দিলেন। মহারাজ খুবই ব্যস্ত ও উদ্বিগ্ন। শীলভদ্র প্রথম দিন মহারাজের নিখুঁত একটি প্রতিকৃতি কাগজে এঁকে নিল। পরের দিন পাথরের গায়ে সেই আকার কাঠকয়লা দিয়ে বুলিয়ে নিল। ছেনি হাতুড়ি দিয়ে আলগা করে কেটে নিল মার্বেল। বাকি কয়েকদিনে দক্ষ হাতে রাজার মুখাবয়ব ফুটিয়ে তুলল পাথরের গায়ে। মহারাজার মুখ দেখে মনে হল তিনি প্রসন্ন হয়েছেন। তিনি তাকে একটি মুক্তোর মালা উপহার দিলেন। শীলভদ্র তাঁকে জানাল, মহারাজের আর সময় দেবার প্রয়োজন নেই বাকি কাজ সে বাগানের প্রমোদকক্ষে বসেই করে নিতে পারবে।

এরপর আরম্ভ হল সবচেয়ে কঠিন আর পরিশ্রমসাধ্য কাজ। পাথরের বুকে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা। গুরুদেব তাকে সবই শিখিয়েছেন। কিন্তু এই বিশেষ গুণটি কোনো গুরু তার শিষ্যদের শেখাতে পারেন না। যে যার মতো করে শিখে নেয়। এই প্রসাদগুণটিই একজন শিল্পীকে আর-একজনের থেকে স্বতন্ত্র করে। শীলভদ্র এই স্বাতন্ত্র অর্জন করার সাধনাতেই কাজের মধ্যে ডুবে গেল। কখন যে রাত হল কখন দিন তার কোনো খেয়াল নেই। ক্লান্ত হয়ে কক্ষেই ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙলে আবার কাজ শুরু করে। গুরুদেব এসে মাঝেমাঝে দেখে যান। নিবিষ্টভাবে নির্মীয়মান মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকেন। মুখে কিছু বলেন না। বিরূপাক্ষ আসে। দুই বন্ধুতে প্রাণের আলাপ হয়। তার হাত দিয়ে মা মাঝেমাঝে বাড়ির খাবার পাঠিয়ে দেন। দু’জনে একসঙ্গে আহার করে।

তবে কাজের বেশিরভাগ সময়ই যুবক শিল্পী ঘরে একা থাকে। তন্ময়ভাবে কাজ করতে করতে তার কখনও কখনও মনে হয় কেউ যেন তাকে আড়াল থেকে লক্ষ করছে। অনেকক্ষণ নিবিষ্টচিত্তে কেউ তার কাজ দেখছে কিন্তু চোখ তুলে কাউকে দেখতে পায় না। মাঝেমাঝে মনে হয় ছায়া সরে যায়, হাওয়া কেঁপে ওঠে। কেউ কাছে আসে না। সে ভাবে তার মনের ভুল। বাগানের গোলাপ গাছে মধুপায়ী মৌটুসিদের আনাগোনা বাড়ে। সে বোঝে বসন্ত এসে গেছে।

দৃষ্টির বিভ্রম হতে পারে কিন্তু ঘ্রাণের তো বিভ্রম ঘটা সম্ভব নয়। নাকে অপূর্ব সুবাস এসে লাগে। ক্রমে সেই সুবাস তীব্র হয়। কাছে এগিয়ে আসে। বাগানের ফুলের সুবাস তার পরিচিত। এই সুবাস সেই সুবাস নয়। এতে যৌবনের আলাপ আছে। এ সুগন্ধ কেবল কোনো যুবতীরই হতে পারে। তবে কে এই যুবতী? বাইরের সতর্ক প্রহরা ফাঁকি দিয়ে কার পক্ষে এখানে আসা সম্ভব?

এভাবেই অনেক দিন কেটে গেল। অবশেষে একদিন সেই জ্যোৎস্নার মায়া যা তার কল্পনাকে অধিকার করেছিল, সরোবরে তার ছায়া এসে পড়ল। রাজার দুলালী চন্দ্রাবতী তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যেভাবে একজন শিল্পী কোনো নারীকে দেখে সেভাবে শীলভদ্র চন্দ্রাবতীর দিকে তাকিয়েছিল। সংবিৎ ফিরলে চোখ নামিয়ে নিলউঠে দাঁড়িয়ে তাকে অভিবাদন করল।

—রাজকুমারীকে শিল্পী শীলভদ্রের নমস্কার।

—শিল্পীর দৃষ্টিতে যে কতটা শ্রদ্ধা তা রাজকুমারী কিছুক্ষণ আগেই লক্ষ করেছেন। নমস্কার জানিয়ে আর কাজ নেই।

শীলভদ্র লজ্জিত হয়। তার কানদুটো লাল হয়ে ওঠে।

—শিল্পীর দেহে তো পুরুষের বলিষ্ঠতা অথচ হৃদয় দেখছি নারীর মতোই লজ্জাশীলা। এ কেমন বৈপরীত্য কুমার?

—শিল্পী যুবক এবং পূর্ব-অভিজ্ঞতাহীন। তারপর নারী রাজনন্দিনী। ভয়ে শিল্পীর হৃদয় রথের গতিতে চলছে। দ্রুত কাজে ভুলের সম্ভাবনা বেশি। তাই হৃদয়কে দোষ দিয়ে লাভ নেই।

—হৃদয় যে দ্রুত চলছে তা কি শুধুই ভয়ে নাকি তাতে অন্য কারণও আছে কুমার?

—আমার বন্ধু বলে চাঁদের জ্যোৎস্না চরাচর ডুবিয়ে দেয়। সরোবরের জলে যার ছায়া পড়ে, সে মায়া আলোর কাছে গেলে তা পুড়িয়েও দিতে পারে।

—শিল্পীর বন্ধুটিও মনে হয় শিল্পীর মতোই পূর্ব-অভিজ্ঞতাহীন। তাই কি?

—যদি বন্ধু হিসেবে দাবি করি বন্ধুর হৃদয়ের কথা জানি, তবে বলি রাজকুমারীর অনুমান সত্যি।

—কুমার কি আমাকে দেখে একটুও অবাক হননি?

—অবাক হয়েছি বললে হয়তো কমই বলা হয়। প্রহরীদের চোখ এড়িয়ে রাজকুমারী কিভাবে এই অচেনা যুবকের কাছে এসে পড়লেন তা জানতে আমি উৎসুক।

—বাইরে তাকিয়ে দেখুন তাহলেই বুঝতে পারবেন।

শীলভদ্র জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল দুই প্রহরী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমোচ্ছে।

—শিল্পী জানবেন রাজকুমারী চৌষট্টিকলায় পারদর্শিনী। তার পক্ষে অসম্ভব কিছুই নেই। মহারাজ এখন রাজনীতি নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত। এদিকে তার নজর নেই।

এভাবেই যে প্রথাগত আলাপের সূচনা হল তা ক্রমেই বন্ধুত্বের স্বাভাবিকতায় পৌঁছে যায়। বসন্ত পেরিয়ে গ্রীষ্ম এসে পড়ে। অনুরাগের প্রাবল্যে শীলভদ্রের কাজও দ্রুত শেষ হয়ে আসে। প্রমোদকক্ষে থাকার দিন ফুরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে আসে দু’টি তরুণ হৃদয়ের পরস্পরকে লুকিয়ে রাখার ছলনা।

—তোমার কাজ তো শেষ হয়ে এল। এবার কী করবে?

—এবার বাড়ি ফিরে যাব। আবার গুরুদেবের কাছে শিক্ষা নেব।

—আচার্যের কাছে তোমার আর শিক্ষা নেবার কিছু নেই। তুমি তোমার গুরুকেও অতিক্রম করে গেছ। এমন শিল্পসৃষ্টি আমি আমার ষোলো বছরের জীবনে আর দু’টি দেখিনি।

—ছি, ছি এ কী বলছ? একজন মহান শিল্পীর সাধনার ধারেকাছে পৌঁছতে হলেও আর-একজন শিল্পীকে কমপক্ষে একটা সম্পূর্ণ জীবন যাপন করতে হবে।

—কিন্তু শিল্পী যদি প্রতিভাধর হন তাহলেও কি তার এক সম্পূর্ণ জীবন লাগবে? শিল্পী নিজেকে তবে প্রকাশ করবেন কবে?

—এক শিল্পীর সারাজীবনের কাজ আর-একজনের হাতে আসে খুব অল্প সময়ের মধ্যে কিন্তু তাঁকে মূল্যায়ন করতে হলে একটা জীবন যথেষ্ট নয়। নত্তুন শিল্পী এর মধ্যেই নিজেকে নিয়ে ভাবেন, গড়ে তোলেন, নতুন হন।

—নতুন মানে কি তাহলে পুরাতনেরই অভিব্যক্তি?

—যে শিল্পী বলেন তাঁর কোনো অতীত নেই, পরম্পরা নেই বুঝতে হবে তাঁর কোনো ভবিষ্যতও নেই।

—এখন থাক সে তত্ত্বকথা। কুমার যে চলে যাবে সে কি আর কখনও এই উদ্যানে ফিরে আসবে না?

—কুমার ব্রাহ্মণ। সামান্য পুরোহিতের ছেলে। বিনা কারণে তার প্রাসাদে ঢোকা বারণ।

—কিন্তু কাজের অছিলাতেও কি সে আসতে পারে না?

—রাজকুমারী যদি তাকে কোনো কাজের বরাত পাইয়ে দেন তবে সে আসতেই পারে। কুমারী নিজের যদি একটা মূর্তি তৈরি করাতে চান তবে সেই বরাতটা যেন আমি পাই।

—এ যে অসম্ভব শীলভদ্র। আমি অন্তঃপুরের নারী। বাবার অনুমতি ছাড়া আমার বাইরে আসাই বারণ। তারপর আবার পরপুরুষের কাছে বসে থেকে নিজের মূর্তি তৈরি করানো। অহোম রাজ্যের একশত বছরের ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেনি। এমনটা যে ঘটবে তারও কোনো সম্ভাবনা নেই।

চন্দ্রাবতীর মুখ বিষণ্ণ হয়ে পড়ে।

—আমি শিল্পী হলেও ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণের শপথ যদি সত্যি হয় তবে আমি আজ শপথ করছি যে সেই অসাধ্যসাধন আমিই করব। কিন্তু তার বিনিময়ে আমি পারিশ্রমিক আশা করি।

—ব্রাহ্মণের শপথ যদি সত্যি হয় তবে এই ক্ষত্রিয়তনয়াও শপথ করছে যে শিল্পীকে সে এমন পারিশ্রমিক দেবে যা সে অন্য কাউকে দ্বিতীয়বার কখনও দিতে পারবে না।

—বেশ তবে তাই হোক। কালই যে আমাকে বিদায় নিতে হবে রাজকুমারী।

রাজকুমারীর চোখ জলে ভরে ওঠে। দু’জনের দৃষ্টি আবদ্ধ হয়ে যায় এক সরলরেখায়। সেই সরলরেখা এক বিন্দুতে পরিণত হতে চায় মুহূর্তের মধ্যে। কিন্তু তাদের মাঝখানে অনেকটা কঠিন সময় আটকে আছে। শীলভদ্র অনুভব করে সেই বরফের পাহাড় তাকেই অতিক্রম করতে হবে।

 

(৩)

কামাক্ষ্যাদেবীর মন্দিরের কাছে যে অস্থায়ী ছাউনি টাঙানো হয়েছে শীলভদ্র সেইদিকে এগিয়ে যায়। ছাউনির ভেতরে বসে এক রাজকর্মচারী ঝিমোচ্ছে। শীলভদ্র তাকে চেনে। বাবার কাছে উনি অনেকবার এসেছেন। শীলভদ্র ডাকায় তাকে দেখে সে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে।

কী হল কুমার এখানে? বাবা কিছু বলে পাঠিয়েছেন নাকি?

না, না। আমি নিজের প্রয়োজনে এখানে এসেছি।

তা তোমার এখানে কিসের প্রয়োজন? আমি এখানে আগামী বছরে ভোগী হতে ইচ্ছুক লোকেদের নাম নথিভূক্ত করছি।

সে আমি জানি। আমি শুনলাম এবার নাকি পাঁচজনের মধ্যে একজনের নাম এখনও নথিভূক্ত করা হয়নি। কথাটা কি সত্যি?

হ্যাঁ, হয়নি বলেই তো আমি এখনও বসে আছি।

পঞ্চম ব্যক্তি হিসেবে আমি আমার নাম নথিভূক্ত করতে চাই।

কী? কী বলছ তুমি? যা বলছ ভেবে বলছ তো? তোমার বাবা তোমার সিদ্ধান্তের কথা জানেন?

না, জানেন না। আমি যৌবনে পা রেখেছি। আমি কি আমার নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারি না? আমি তো শুনেছি ভোগী হতে চাওয়া পারলৌকিক পুণ্যের জন্য। স্বয়ং মহারাজও সেই ইচ্ছেয় বাধা দিতে পারেন না। আপনি আমার নাম নথিভূক্ত করুন।

সে আমি করছি। তবে আমি তোমার বাবার সঙ্গে ও মহারাজার সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করে তোমাকে জানাব।

আচ্ছা আমি আজ আসি। কাল এসে আমি এ নিয়ে খোঁজ নিয়ে যাব।

শীলভদ্র বাড়ির দিকে রওনা হয়। খুব ইচ্ছে করছিল গুরুদেবের সঙ্গে দেখা করার। কিন্তু কি মনে হওয়ায় বৃদ্ধ মানুষটিকে আর বিরক্ত করতে ইচ্ছে হল না। তার সিদ্ধান্তের কথা শুনলে তিনি অসুস্থও হয়ে পড়তে পারেন। তাই তাঁর বাড়ির দরজার কাছে এসেও সে ফিরে গেল।

রাতের বেলায় খাওয়াদাওয়া সেরে শীলভদ্র নিজের ঘরে এসে শুয়েছে। চোখে ঘুম আসছে না। বাইরে বর্ষার ভ্যাপসা আবহাওয়া। অহোম রাজ্যে এ বছর বর্ষা আসতে দেরি হচ্ছে। জানলা দিয়ে দূরে রাজবাড়ি দেখা যায়। সেইদিকে তাকিয়ে তার চন্দ্রাবতীর কথা মনে হল। কখনও মনে হচ্ছে সে এতদূর না এগোলেও পারত। আবার কখনও মনে হচ্ছে এছাড়া তার হাতে অন্য কোনো উপায় ছিল না।

বাড়িতে মা ও দাদারা তার সিদ্ধান্তের কথা জানেন না। বাবা হয়তো এতক্ষণে জেনে গেছেন। অগোছালো চিন্তায় একটু তন্দ্রার মতো এসেছিল। ঘুম ভাঙল বাবার ডাকে।

শীলভদ্র তুমি আমার ঘরে একবার এসো

সে বাবার ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখল বাবার ঘরের দরজার পাশে মা আর বড়দা দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের চোখে জল। মুখে আঁচল দিয়ে কান্না চাপার চেষ্টা করছেন।

বলুন বাবা আমাকে ডেকেছিলেন?

আমি যা শুনলাম তা কি সত্যি?

হ্যাঁ বাবা, আমি অনেক ভাবনাচিন্তা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

তুমি কি তোমার জীবন নিয়ে খুশি নও? এই কয় বছরের জীবনে এমন কী ঘটেছে যাতে তুমি জীবন সম্পর্কে এত হতাশ হয়ে পড়েছ?

আমি জীবন নিয়ে মোটেই হতাশ নই। জীবন নিয়ে আমার জিজ্ঞাসার কোনো শেষ নেই।

তাহলে এভাবে জীবনকে শেষ করে দিতে চাইছ কেন?

‘এভাবে’ বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?

তুমি যুবক এবং প্রতিভাধর। এই পৃথিবীকে দেবার মতো অনেক কিছু তোমার আছে।

আমি দিতেই তো চাইছি। আমার সামান্য জীবন দিয়ে যদি অহোম রাজ্যের সামান্য দরিদ্র মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটাতে পারি তবে এর চেয়ে বেশি কিছু চাইবার আর কী থাকতে পারে আমার?

তুমি একজন সম্ভাবনাময় শিল্পী। মহারাজের যে ভাস্কর্য তুমি নির্মাণ করেছ এতে মহারাজ শুধু উচ্ছ্বসিত নন হতবাক হয়ে গেছেন। উনি চান তুমি তোমার সিদ্ধান্তের পুনর্বিবেচনা করো

আমি অনেক ভেবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ থেকে সরে আসার কোনো উপায় আমার নেই।

সত্যি করে বলো তো তুমি কি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আমাকে শাস্তি দিতে চাইছ?

সে অধিকার বা ক্ষমতা কোনোটাই আমার নেই বাবা। আমি শুধু চাই আপনি যতদিন জীবিত আছেন ততদিন আপনার অন্তর্দাহ হোক। আপনি যাতে বুঝতে পারেন যেসব পরিবার এই কুপ্রথার শিকার তারা সারাজীবন ধরে কতটা যন্ত্রণা বয়ে বেড়ায়।

তুমি কি মনে করো পুত্রশোকে আমি আমার সিদ্ধান্তের পরিবর্তন করব?

আমি আপনাকে যতদূর চিনি তাতে আমার মনে হয় সিদ্ধান্তের পরিবর্তন করার মানুষ আপনি নন। আপনি ভক্তি ও সংস্কারের ঘেরাটোপে অন্ধ হয়ে আছেন।

শীলভদ্র! বাক্য সংবরণ করোতবে আমি এই ভেবে আশ্বস্ত হলাম যে তোমার আক্রমণের লক্ষ্য কেবলমাত্র আমি। এই শোক ও শ্লেষ আমিই সারাজীবন বয়ে বেড়াব। আমার ভবিষ্যৎ মা ভবতারিণীর হাতে। তিনিই আমাকে পথ দেখাবেন।

আমি কি এখন আসতে পারি?

কাল প্রত্যূষে প্রস্তুত হয়ে থেকো। রাজকর্মচারীরা এসে তোমাকে নিয়ে যাবে।

শীলভদ্র এগিয়ে এসে বাবাকে প্রণাম করল। বাবা তার মাথায় হাত রেখে বললেন, আমি তোমাকে যতদূর চিনি তুমি কিছু পরিকল্পনা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছ। আমি মা ভবতারিণীর কাছে প্রার্থনা করি তুমি তোমার উদ্দেশ্যে সফল হও।

শীলভদ্র বাইরে বেরিয়ে আসে। মা তাকে বুকে টেনে নিলেন।

বাবা তুই এই সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমার কথা একবারের জন্যও ভাবলি না? তোর বাবা যা বললেন তা কি সত্যি? তোর মনে সত্যিই যদি কিছু থাকে তুই কি আমাকেও বলতে পারিস না? আমাকেও এত পর করে দিলি বাবা? এ জীবনে তো অনেক কিছুই সহ্য করেছি। তুই কি এবার সন্তানের মৃত্যুশোকও আমাকে সহ্য করাতে বাধ্য করবি?

আমার মনে অন্য কিছু নেই মা। আমার মনে যা কিছু আছে তা আমি বাবাকে স্পষ্ট করে বলেছি।

রাজার অনুচরেরা অত্যন্ত যত্ন ও মর্যাদার সঙ্গে তাকে বাড়ি থেকে ঘোড়ায় করে নিয়ে গেল। মা রাত থেকেই বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন। শীলভদ্র অচেতন মাকেই প্রণাম করে ঘোড়ার পিঠে চেপে বসল। বাড়ির লোকেরা, পরিজনেরা, পাড়ার লোকেরা সবাই জলভরা চোখে তার যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে থাকল।

পাশাপাশি পাঁচটি বিলাসবহুল কক্ষে পাঁচজন ভোগীকে রাখা হয়েছে। বাকি চারজন সে আসার আরও ছয়মাস আগে থেকেই এখানে আছে। বাকিদের বয়স তার থেকে অনেক বেশি। দু’জনকে তো বৃদ্ধই বলা চলে। সে আসায় অন্যরা তাকে অভ্যর্থনা জানাল। একজন তো কেঁদেই ফেলল। সে কান্না আর থামে না। অনেক কষ্টে তাকে শান্ত করা গেল। প্রতিটি কক্ষে পাঁচজন ভোগীর জন্য রোজ নানান সুস্বাদু খাবারদাবার আসে। সেই পরিমাণ এত বেশি যে একজনের পক্ষে খাওয়া সম্ভব না। অবলীলায় একজনের খাবার দিয়ে পাঁচজনের হয়ে যাবে। পঞ্চব্যঞ্জন ছাড়াও মাংস ও মিষ্টান্নর নানান পদ। তার সঙ্গে অহোম রাজ্যের সেরা মদিরা তো আছেই। রাজা যে সুরা প্রতিদিন পান করেন তার থেকে এই সুরা কোনো অংশে কম নয়। শীলভদ্র লক্ষ করল চারজন এই ছ-মাসেই অসম্ভব স্থূল হয়ে গেছে। সারাদিন মদের নেশায় তাদের আচরণ ও কথাবার্তা অসঙ্গত। তারা এর মধ্যেই তাদের মানসিক আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে।

শীলভদ্র বুঝতে পারল এখানে মদিরার সঙ্গে নিয়মিত মাদক মেশানো হয়। এক বছর ধারাবাহিক মাদকের প্রভাবে এদের শুধু ব্যথাবেদনাই নয় মানবিক অনুভূতিগুলোও নষ্ট হয়ে যায়। এক বছর পরে এদের যখন বলি দেওয়া হয় তখন সেটাতেই যেন তাদের উপযুক্ত সৎকার করা হয়। মেরে ফেলার অনেক আগেই এই মানুষগুলো মরে গেছে।

এরপর ব্যাভিচার তো আছেই। প্রতি রাতে অভিজাতদের জন্য নির্দিষ্ট রক্ষিতারা তাদের সঙ্গে সঙ্গম করতে আসে। অধিকাংশেরই আর সঙ্গমের বয়স ও ক্ষমতা নেই তবু লালসায় এই লোকগুলো হিংস্র হয়ে গেছে। অতৃপ্ত বারবণিতারা নৈশপ্রহরীদের সঙ্গে মিলিত হয়। দেবীর কাছে বলির নামে কত যে কদর্যতা চলে তা শীলভদ্র নিজের চোখে দেখতে পেল

শীলভদ্র এসবের বাইরে। সে সীমিত আহার করে। মদ ও নারী স্পর্শ করে না। সারাদিন মার্বেলের গায়ে মুখাবয়বহীন এক নারীমূর্তিকে ফুটিয়ে তুলতে চায়। তার যৌবনের সব কামনা ও লালসা ফুটে ওঠে নগ্ন ভাস্কর্যে। এক রাতে সে যখন নিমগ্ন হয়ে কাজ করছে তখন দরজায় টোকা পড়ে। দরজা খুললে দেখে এক অসম্ভব রূপসী বারাঙ্গনা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে

কুমার কি ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেবেন না?

যতক্ষণ আপনার উদ্দেশ্য জানতে না পারছি ততক্ষণ নয়।

মাঝরাতে অভিসারিকা সুসজ্জিত হয়ে কী উদ্দেশ্যে পুরুষের কাছে আসে তা বোধহয় কুমারের অজানা নয়।

আমার নারীতে রুচি নেই

কিন্তু কুমারের হাতে গড়া নগ্ন নারীমূর্তিরা তো অন্য কথা বলছে

আমার জীবনের সব কামনা আমার শিল্পেই শেষ হয়ে গেছে। আর কিছু অবশিষ্ট নেই।

কুমার কি তাহলে কথাকলিকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন?

আমি আমার অভিরুচি স্পষ্ট করে দিয়েছি।

কুমার কি ঊর্বশীর অভিশাপের কথা ভুলে গেছেন?

যে জীবনের চরম শাস্তিকে স্বেচ্ছায় বরণ করে নিয়েছে অভিশাপ তাকে আর কী পোড়াবে?

কুমারের হৃদয় নারীর থেকেও জটিল। তা সহজে প্রকাশিত হয় না।

আমার হৃদয় শিল্পীর। কেবল আমার সৃষ্টিকর্মেই আমার মনের ছায়া পড়ে।

অন্তিম মাস যত এগিয়ে আসে তত শীলভদ্র লক্ষ করে অনেক মানুষ তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। সে বোঝে কেউ তাদেরকে তার কাছে পাঠাচ্ছেন। সেটা বুঝে সে তত বেশি করে নিজেকে গোপন করে রাখে।

অবশেষে অন্তিম মাস এসে পড়ে। আর একমাস পরেই দেবীর উৎসব। নিয়ম অনুযায়ী মহারাজা নরনারায়ণ ভোগীদের অন্তিম ইচ্ছে পূরণ করার জন্য তাদের সঙ্গে দেখা করেন। ভোগীদের অন্তিম ইচ্ছে পূরণ করা অন্যতম রাজকর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এটাই চিরকালীন পরম্পরা।

সবার শেষে মহারাজ শীলভদ্রের সঙ্গে দেখা করলেন। সে রাজাকে অভিবাদন জানালরাজা তার দিকে তাকিয়ে তাকে ভালোভাবে নিরীক্ষণ করলেন।

কুমার তো শুনলাম এই ছ-মাস সকল ভোগসুখ পরিহার করেছেন। মা ভবতারিণী কি এই ভোগীকে স্বীকার করবেন?

মা ভবতারিণী এতকাল ভোগীর রক্তপান করেছেন। এবার তিনি যোগীর রক্তপান করবেন।

মহারাজ গম্ভীর হলেন। কঠিন রসিকতা শোনা তাঁর অভ্যাসবিরুদ্ধ।

মৃত্যুর আগে কুমারের শেষ ইচ্ছে জানতে চাই। রাজা হিসেবে তা পূর্ণ করা আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।

আমার জীবনের যে একমাস বাকি আছে সেই সময়ে আমি রাজনন্দিনীর একটি মর্মরমূর্তি তৈরি করতে চাই। আমি চাই মহারাজের রাজত্বের কুড়ি বছর পূর্তির যে উৎসব হবে সেখানে আমার হাতে গড়া মহারাজের মূর্তির পাশে তার মূর্তিটিও যেন শোভা পায়।

অসম্ভব! (রাজা ক্রোধে ফেটে পড়েন) তোমার দুঃসাহস কিভাবে হয় এমন ইচ্ছে প্রকাশ করার। রাজনন্দিনী অন্তঃপুরবাসিনী। পরপুরুষের সামনে তিনি কখনওই আসতে পারবেন না। আর মূর্তির তো প্রশ্নই নেই। তুমি অন্য কিছু কামনা করোরাজা পূরণ করবেন।

আমি যতদূর জানি ভোগীদের জীবনভিক্ষা ছাড়া অন্য যে কোনো কিছু বাসনা পূরণ করতে মহারাজ দায়বদ্ধ। নইলে তাঁর এবং তাঁর পরিবারের অমঙ্গল অনিবার্য। আমি এমন কিছু চাইনি যা মহারাজ পূরণ করতে পারবেন না।

তোমার স্পর্ধা দেখে আমি বিস্মিত হচ্ছি। জানো, তরবারির এক আঘাতে আমি তোমার শিরশ্ছেদ করতে পারি।

মহারাজের যদি তাই অভিরুচি হয় তবে আমি এখনই প্রস্তুত।

বেশ তুমি যা চাইছ তাই হবে। তবে আগামীকাল রাজকুমারী চন্দ্রাবতী সামান্য কিছু সময় তোমাকে দেবেন। তার মধ্যেই তোমার কাজ তোমাকে শেষ করতে হবে।

 

(৪)

পরের দিন রাজার অনুচরেরা তাকে সেই ঘরে নিয়ে গেল যেখানে একদিন মহারাজ তাকে মূর্তি নির্মাণ করার জন্য সময় দিতেন। মার্বেলের পাশে দাঁড়িয়ে শীলভদ্র অপলক দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত চন্দ্রাবতীর দিকে তাকিয়ে থাকল। এই ক’দিনেই রাজকুমারীর দেহ রুগ্ন হয়ে গেছে। তবে তার মুখে এক প্রসন্নতা যেন সে লক্ষ করল। বহুদিন ধরে কোনো প্রশ্ন কাউকে ক্ষতবিক্ষত করলে তার উত্তর জানার পর যে প্রসন্নতা আসে সেই প্রসন্নতা শিল্পী দেখতে পেল চন্দ্রাবতীর চোখে। সে মনে মনে ভাবল এই রূপটাই সে তার শিল্পে ফুটিয়ে তুলবে।

বাকি একমাস শীলভদ্র দিনরাত এক করে তার প্রেয়সীর মূর্তি তৈরি করল। তার সারাজীবনের শিক্ষা, প্রেম, লালসা, সাহস ও স্বার্থত্যাগ সবই তার শিল্পে প্রতিফলিত হল।

যেদিন দেবীর মন্দিরে বলিদান হবে তার আগের দিন সেই মূর্তিকে পৌঁছে দেওয়া হল রাজার কাছে। রাজা তার কন্যার সেই মূর্তি দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। চন্দ্রাবতী অনুভব করল তার চারপাশ যেন জ্যোৎস্নায় ভরে গেছে। ব্রাহ্মণ তার প্রতিশ্রুতি পালন করেছে। সে বুঝল এবার তার প্রতিশ্রুতি পালনের সময় এসে গেছে।

রাতের বেলা চন্দ্রাবতী বাবার সঙ্গে দেখা করতে রাজকক্ষে প্রবেশ করল। রাজা নরনারায়ণ অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন। মেয়েকে দেখে তিনি তার দিকে ফিরে তাকালেন।

—কী হল মা, কিছু বলবে?

বাবা আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই।

নির্ভয়ে বলো

যুবক শিল্পী শীলভদ্র, যে কালকে ভবতারিণীর কাছে বধ্য হবে আমি অনেক আগেই তাকে আমার হৃদয় দান করেছি। তাই তাকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে কোনোদিন গ্রহণ করতে পারব না।

রাজার অস্থিরতা কিছুটা কমল। বিগত কয়েকমাস ধরে যা খুঁজছিলেন এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর তিনি পেয়ে গেলেন। একই সঙ্গে প্রচণ্ড রাজকীয় ক্রোধ তাঁকে অধিকার করল। যথাসম্ভব শান্ত থেকে তিনি বললেন, শীলভদ্র স্বেচ্ছায় ভোগী হয়েছে। সে নিজেকে দেবীর চরণে উৎসর্গ করতে চায়। তাকে বাধা দেবার কোনো অধিকার আমার নেই। এটাই অহোম রাজ্যের পরম্পরা। বিগত দুশো বছর ধরে চলে আসছে। আমি এর রক্ষাকর্তা। এই প্রথা ধ্বংস করার কোনো অধিকার আমার নেই।

কিন্তু মহারাজ আমারও যে ক্ষত্রিয়ার শপথ। আমারও যে পেছনে ফেরা অসম্ভব।

তুমি আমার একমাত্র সন্তান। আমার হৃদয়ের অর্ধেকটাই তোমার। জীবনে তোমার কোনো সাধ আমি অপূর্ণ রাখিনি। অহোমের সমক্ষমতার রাজ্যের রাজা ও রাজপুত্ররা তোমাকে তাদের রানি হিসেবে পেতে উদগ্রীব। আমি আশা করব তুমি তোমার সিদ্ধান্তের পুনর্বিবেচনা করবে।

আমি অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি মহারাজ। মা ভবতারিণী আমাদের দু’জনের ভাগ্যের সুতো এক মালায় গেঁথে দিয়েছেন। আমাদের নিয়তিও তাই এক হবে।

বেশ এই যদি তোমার ইচ্ছে হয় তবে কাল মা ভবতারিণীর পুজোর সূচনায় উপস্থিত থেকে তুমি নিজের চোখে তোমার প্রেমিকের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করবে।

এর আগে কোনোদিন আমি স্বেচ্ছায় এই হিংস্র ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করিনি। এবারও করব না। এই প্রথাকে আমি ঘৃণ্য বলে মনে করি। দেবী জীবনদানের পরিবর্তে জীবন কেড়ে নিতে চান এটা আমার বিশ্বাস হয় না। আপনিও রাজকর্তব্যে অন্ধ হয়ে গেছেন তাই এসব আপনার চোখে পড়ছে না। আজ না হোক কোনো একদিন এর বদল ঠিকই আসবে। আমাদের মৃত্যুই না হয় এর সূচনা করে দিয়ে যাবে।

চন্দ্রাবতী! তুমি নিজের সীমা লঙ্ঘন করে ফেলছ।

মহারাজ আমার এটুকুই বলার ছিল। কুমারকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি আমি পালন করেছি। বাকিটা মা ভবতারিণীর হাতে। তিনিই আমার উপাস্য। আমার পাপপুণ্য বিচার করার দায়িত্বও তাঁর।

চন্দ্রাবতীর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। সে দ্রুতপায়ে নিজের কক্ষের দিকে ফিরে চলে। আকাশে তখন অমাবস্যার চাঁদ। অহোম রাজ্যের চারিদিকে ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বলে উঠেছে। সবাই ভক্তিভরে কাল দেবীপূজার অন্তিম প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন। মহারাজ নরনারায়ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের পালঙ্কে এসে বসলেন। জীবনে এত কঠিন পরিস্থিতিতে তিনি আগে কখনও পড়েননি। দূরে মায়ের মন্দিরে সন্ধ্যার আরতি শুরু হল। কাঁসর-ঘণ্টার প্রতিটি শব্দ তাঁর বুকে ঝড় তুলে দিল।

 

(৫)

মা ভবতারিণীর মন্দিরের পাশে বিরাট প্রাঙ্গণে অহোম রাজ্যের প্রচুর প্রজা, অভিজাত ও তাদের পরিবারের লোক এবং অনেক বিদেশি রাজা ও সম্মানিত অভ্যাগতরা সমাগত হয়েছেন। প্রতিবারের চেয়ে এ বছর দেবীপূজার সূচনা কিছুটা আলাদা। কারণ এ-বছর মহারাজের রাজত্বকালের বিশ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান একই সঙ্গে শুরু হবে। প্রজারা তাই উল্লসিত।

প্রাঙ্গণের মাঝে যজ্ঞের বেদিতার পাশে যূপকাষ্ঠ। প্রতি বছর এখানেই পাঁচজন ভোগীকে বলি দেওয়া হয়। তার পরে তাদের রক্ত দিয়ে দেবীর মূর্তি যা কিনা যোনির আধারের ওপর স্থাপিত একটি বিরাট লিঙ্গসদৃশ শিলাখণ্ড তাকে স্নান করানো হয়। মনে করা হয় এরপর দেবী রজঃস্বলা হবেন এবং গর্ভগৃহ পরবর্তী চোদ্দোদিন বন্ধ রাখা হয়।

ভোগীরা প্রাঙ্গণের পাশে উপবিষ্ট। চামর দুলিয়ে তাদের বাতাস করা হচ্ছে। চারজনের কোনো হুঁশ নেই। মাদকের প্রভাবে তারা প্রায় সংজ্ঞাহীন। একজনই শুধু ঋজু হয়ে যূপকাষ্ঠের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মনোযোগ ছিন্ন হল যখন মহারাজ তাঁর মহিষী, কন্যা এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে বিশেষভাবে তৈরি মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলেন। সকল অভ্যাগতরা আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে অভিবাদন করল। প্রজারা জয়ধ্বনি দিল, “জয় মহারাজ নরনারায়ণের জয়”। মহারাজ প্রতিবারের মতোই হাত তুলে প্রজাদের অভিবাদন গ্রহণ করলেন এবং পূজার সূচনার ইঙ্গিত দিয়ে প্রারম্ভিক ভাষণ দেবার জন্য প্রথামাফিক মঞ্চের কাছে এগিয়ে এলেন।

রাজা এগিয়ে আসতে প্রজাদের উন্মাদনা আরও বেড়ে গেল। রাজা হাত তুলে সকলকে শান্ত করলেন।

“আমার প্রিয় অহোম রাজ্যের প্রজা ও মাননীয় অভ্যাগতগণ। প্রতিবারের মতো এবারেও আমরা দেবীপূজার প্রারম্ভে এই পবিত্র প্রাঙ্গণে সমবেত হয়েছি। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই দেবীর পূজা আরম্ভ হবে।

পাঁচজন ভোগী মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত। তারা তাদের নিজেদের পারলৌকিক ও অহোম রাজ্যের ইহলৌকিক মঙ্গলের জন্য দায়বদ্ধ। বিগত দুই শতাধিক বছর ধরে এই পরম্পরা চলে আসছে। কিন্তু আজ এত বছর পরে এসে আমার মনে এ প্রশ্ন জেগেছে এই যে নরবলি, নরহত্যা দেবী কি সত্যিই তা চান?

যে মা ভবতারিণী আমাদের সকলের মা তিনি তো ওই হতভাগ্য মানুষগুলোরও মা। মা কি তাঁর সন্তানের নিধন চান? আমি রাজা। সকলের পালক পিতা। ওই অবলা মানুষগুলোরও তো আমি রক্ষাকর্তা। আমি তো প্রাণ দিতে পারি না। প্রাণ নেবার অধিকার কি আমার আছে?’’

প্রজাদের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে। আমলারা এ-ওর মুখ চাওয়াচায়ি করেন। রাজপুরোহিত কালভৈরবের মুখে হালকা হাসির রেখা খেলে যায়। চন্দ্রাবতীর হৃৎস্পন্দন আরও দ্রুত হয়ে ওঠে।

‘‘আমি তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর নয়। এই হিংস্র প্রথা এবার থেকেই বন্ধ করতে হবে। এবার থেকে মায়ের পুজো হবে তবে নরবলি হবে না। মহাভারতের যুগেও নরবলি ছিল না। অশ্বমেধ যজ্ঞ হত। আমরাও পাঁচটি বলীবর্দ বধ করে দেবীকে রজঃস্বলা করব।

সম্প্রতি আমার অহোম সেনারা বীরত্বের সাথে লড়াই করে পাশের রাজ্যের বর্বরদের প্রতিহত করে রাজ্যে সুস্থিতি ফিরিয়ে এনেছেন। এ সবই মায়ের অপার কৃপা। আজ তাই আমি ঘোষণা করছি এ বছরের উৎসব শেষ হবার সাথে সাথে নীলাচল পাহাড়ের ওপর আমি দেবী ভবতারিণী কামাক্ষ্যার প্রকাণ্ড মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করব। তার প্রধান দায়িত্বে থাকবে যুবক শিল্পী শীলভদ্র যে কিনা ভোগী হয়ে আজ নিজেকে মায়ের চরণে সমর্পিত করতে চেয়েছিল।

এমন ভাস্কর অহোম এর আগে দেখেনি। সে স্থপতি বিল্বদলের সার্থক শিষ্য। আগামী কয়েকদিন বাদেই তার অসাধারণ স্থাপত্যকীর্তির নমুনা আমি আপনাদের সামনে রাখব। আমি আশা করব নীলাচল পাহাড়ের ওপর এমন মন্দির শীলভদ্র নির্মাণ করবে যাকে যুগে যুগে মানুষ দর্শন করে বিস্মিত হবে।

মন্দির নির্মাণে প্রচুর দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন। আমি কথা দিচ্ছি দ্বিগুণ পারিশ্রমকে আমি আমার রাজ্যের প্রজাদের এই কাজে নিযুক্ত করব। এই বছর আমার রাজত্বের বিশ বছর পূর্ণ হবে। সে উপলক্ষ্যে অহোম নগরীতে সারা বছর ধরে আনন্দ-উৎসব চলবে। এক বছর ধরে রাজপরিবার প্রজাদের বিনা খরচায় দু’ বেলা খাবারের ব্যবস্থা করবে। আমার প্রজাদের সুখ ও সমৃদ্ধির দায়িত্ব আমার। অহোম সাম্রাজ্য দীর্ঘজীবি হোক

তাঁর বক্তব্য শেষ হতেই প্রজাদের মধ্যে বিপুল উন্মাদনা সৃষ্টি হল। সকলে জয়ধ্বনি দিল, “জয় মহারাজ নরনারায়ণের জয়। জয় দেবী ভবতারিণী কামাক্ষ্যার জয়

 

(৬)

এরপর বেশ কয়েক মাস অতিক্রান্ত। প্রাসাদের রম্যকক্ষে নব্যবিবাহিত দুই নারী-পুরুষ রমণসুখে মগ্ন। মিলনের পর রমণক্লান্ত স্বামীর বুকে মাথা রেখে নববধূ বলে উঠল, আমি তো খুব চিন্তায় ছিলাম নধরকান্তি বামুনের ব্যাটা ক্ষত্রিয়া রমণীর ধক্‌ সামলাতে পারবে কিনা?

তা বীরাঙ্গনা কী দেখলেন? বামুনের ব্যাটা কি পরীক্ষায় উতরেছে?

বামুনের ব্যাটা বারেবারে আমাকে ভুল প্রমাণ করেছে। তার হৃদয় নারীর থেকেও জটিল। তার নাগাল পাওয়া আমার অসাধ্য।

এই বলে স্বামীর বামদিকের স্তনে দাঁত দিয়ে হালকা কামড় বসিয়ে দিল।

যুবক স্বামী মনে মনে ভাবল যাক ঊর্বশীর অভিশাপ শেষ পর্যন্ত কাজে আসেনি।

 

 

 

No comments:

Post a Comment