প্র। ব্রাজিলের শিল্প-সাহিত্য নিয়ে যদি কিছু বলেন।
উ। ব্রাজিলের রাজধানী রিও দি জেনেইরো। কিন্তু সাহিত্যের বা
শিল্পের কথা বলতে গেলে একদিকে উঠে আসবে সাউ পাউলোর নাম, অন্যদিকে বাইয়া উপকূল। গত
শতকের শেষ দিকে, ১৯৮০-৯০, এই সময়কালে ব্রাজিলের চলচ্চিত্রও সবার মন কেড়েছিল।
একেবারেই অন্যরকম সমস্ত ছবি। তাতে জীবনের বাস্তবতা আর কল্পনা সব মিলেমিশে একাকার
হয়ে গেছিল। যেমন ধরো, ষাট-সত্তর দশককে বলা হতো, পোলিশ সিনেমার যুগ,
ভাইদা-পোলানস্কি তখন দাপিয়ে বেরাচ্ছেন, সত্তরে তৈরি হচ্ছে চেক বা স্লোভাকিয়ার
অসামান্য সব ছবি, 'শপ অন দ্য মেইন স্ট্রিট', 'ক্লোজলি ওয়াচড ট্রেন'...
প্র। দ্বিতীয়টা তো বহুমিল হ্রাবালের গল্প নিয়ে। জিরি মেনজেলের
পরিচালনা।
উ। ঠিক তাই। সেরকমই আশির দশকটাকে বলা যায়, ব্রাজিলের সিনেমার।
কী সব ছবিই না তৈরি হয়েছে তখন! একটা মজার ও ভয়ের ছবির কথা সবার আগে বলা উচিত।
ছবিটির নাম, 'বাই বাই ব্রাজিল।' ব্রাজিলকে বিদায় জানানো এই ছবি যদি লক্ষ্য করি,
তাহলে অনেকগুলি জিনিসই আমাদের কৌতূহলকে উসকে দিতে পারে। সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদের
ভয়াবহতা আমাদের চোখে পড়ে যাবে। ছবির গল্পটি এইরকম- একটি নাটকের দল মফস্বলে,
গ্রামে, ছোট শহরে অভিনয় করে বেড়াত এবং লোকের মন কেড়ে নিতো। হঠাৎ একদিন তারা ঢাকঢোল
পিটিয়ে প্রচার করলো, তাদের অভিনয় দেখতে লোক আসছে না। কী হলো, কেন এমন হলো, তারা
নিজেরাই কিছুতে বুঝে উঠতে পারছে না। কখনও মনে হচ্ছে, তাদের নাটকের পরিকল্পনায় কোনও
গলদ থেকে যায় নি তো? পরে দেখা গেল, সন্ধ্যের পর লোকে বাড়ি থেকে বেরোতেই চাইছে না।
তারা টিভির সামনে বসে বসে দেখছে সব হলিউডি সিরিয়াল। টিভি তখন নতুন আর সব প্রোগ্রাম
দখল করে নিয়েছে মার্কিন মুলুক। তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গেল, অভিনয় করবে
বলে প্রচারও করলো, কিন্তু লোক আর হলো না। কী কারণ? সেই টিভির সিরিয়াল। এইভাবে একের
পর এক শহরে তাদের একই অভিজ্ঞতা হলো। আর শেষ পযর্চন্ত তারা দেশ ছেড়েই চলে যেতে
বাধ্য হলো! যেতে যেতে বলে গেল, 'বাই বাই ব্রাজিল!' এই চমকপ্রদ চলচ্চিত্র বুঝিয়ে
দেয়, আমাদের চিন্তা, মনন ও সংস্কৃতির জগতকে কী করে উপনিবেশবাদ সাত পাকে জড়িয়ে
ফেলেছে! এরকম অনেক সিনেমাই দেখেছিলাম...
প্র। গ্লবার রচার কথা নিশ্চয়ই বলবেন, বিশেষ করে, 'ব্ল্যাক গড,
ওয়াইট ডেভিল।'
উ। হ্যাঁ, তবে আরও সিনেমার কথা মনে আছে। ওখানে একসময়
বর্ণবৈষম্য ছিল বলে শোনা যায়। একটা ছবি দেখেছিলাম। তাতে এই বিষয়টি ছিল। হোর্হ আমাদুর গল্প নিয়ে অনেকগুলো ছবি তৈরি হয়েছিল। যেমন, 'গ্যাব্রিয়েলা, ক্লোভ অ্যাণ্ড
সিনামন' বা 'দোনা ফ্লোর অ্যাণ্ড হার টু হাজব্যাণ্ড।' মাচাদো দ্য আসিসের কাহিনি
নিয়েও ছবি তৈরি হয়েছে। যেমন, 'ডম কাসমুরো' বা 'দি সাইকিয়াট্রিস্ট'। এই দ্বিতীয় নভেলাটি 'মনোচিকিৎসক' নামে আমি বাংলায় অনুবাদ করেছি। এই সব ছবিই একসময় খুব আগ্রহ
নিয়ে দেখেছিলাম।
প্র। ব্রাজিল নিয়েই মারিও ভার্গাস লোসা লিখেছেন তাঁর সবচেয়ে
উল্লেখযোগ্য উপন্যাস, 'দি ওয়ার অব দ্য এণ্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড।' এ বিষয়ে যদি কিছু
বলেন।
উ। ব্রাজিল গড়ে উঠেছিল পর্তুগাল থেকে আসা অভিযাত্রীদের
মারফত। আর পরে নানা দেশ থেকে সেখানে অনেকেই বসবাসের জন্য এসেছিলেন। যেমন, ক্লারিস
লিসপেকটরের বাবা-মা দু'বছরের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ইউক্রেন থেকে এসেছিলেন। যারা ইউরোপ
থেকে এসেছিল, তারা তো এখানে কোনও ফাঁকা ময়দান পায়নি। তারা এখানকার জনজাতি বা
সাধারণ লোকেদের ওপর প্রচণ্ড অত্যাচার চালিয়েছিল। সে নিয়ে একটা প্রচণ্ড রাজনৈতিক
গণ্ডগোল চলছিল। এরই জেরে একদিন রাজতন্ত্রকে হটিয়ে দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়। অথচ এরই বিরুদ্ধে আবার জন-প্রতিরোধও গড়ে ওঠে। বিশেষ করে বহুদিনব্যাপী আন্দোলন
করেছিল গ্রাম্য এক মোহান্ত। সে দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে চষে বেড়িয়ে
লোকেদের গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে চেয়েছিল। এই ঘটনা নিয়েই পেরুর ঔপন্যাসিক
ভার্গাস লোসা তাঁর সেই মস্ত উপন্যাস লিখেছিলেন।
প্র। ব্রাজিল তথা গোটা দুনিয়ার চিন্তাচেতনার জগতে পাওলো
ফ্রেরি ও তাঁর দু'টি গ্রন্থ 'পেডাগজি অফ দ্য অপ্রেসড' এবং 'পেডাগজি অফ হোপ' খুবই
উল্লেখযোগ্য। এ বিষয়ে আপনার মত কী?
উ। দ্যাখো, 'নিপীড়িতের বাককৌশল' তো অত্যাচারীর মতো হয় না।
তাঁর কথায় যেমন আত্মরক্ষার তাগিদ থাকে, তেমনই অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোরও
প্রবল ইচ্ছে থাকে। আর এইসব নিয়েই তো লিখেছিলেন ফ্রেরি।
প্র। ব্রাজিলের কবিতাও তো আপনি অনুবাদ করেছেন। বিশ শতকের
ব্রাজিলের সবচেয়ে প্রভাবশালী কবি যাকে বলা হয়, সেই কার্লোস দ্রুমন্দ দি
আন্দ্রাদের কবিতা আপনার অনুবাদেই আমরা পেয়েছি। এ বিষয়ে যদি কিছু বলেন।
উ। হ্যাঁ, কার্লোস দ্রুমন্দ দি আন্দ্রাদের কবিতার একটি সংকলন
বাংলায় প্রকাশ পেয়েছে। সংকলনটির নাম, 'মাঝরাস্তায়।' উনিশ শতকের শেষ ভাগ থেকেই
ব্রাজিলের কবিতায় একটা নতুন আলোড়ন তৈরি হয়েছিল। এই আলোড়ন ফেলে দেওয়া কবিদের মধ্যে
উনিও ছিলেন একজন। কবিদের মধ্যে তখন যারা সাউ পাউলোতে নজর কেড়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে
আরও ছিলেন, মারিও দ্য আন্দ্রাদে, অসওয়াল্ড দ্য আন্দ্রাদে, ম্যানুয়েল ব্যানডেইরা
প্রমুখ।
প্র। আর আপনার কথাসাহিত্য পাঠের অভিজ্ঞতা?
উ। মাচাদো দ্য আসিসকে ওপর ওপর পড়লে মনে হয়, সাদামাটা, আড়ালে
থাকে শ্লেষ, পরিহাস, বিতর্ক, প্রশ্ন, হেঁয়ালি। আর থাকে মনস্তত্বের গভীরে পৌঁছনোর
একটা চেষ্টা। হোর্হ আমাদু এত বই লিখেছেন, কিন্তু বিষয়বস্তু, প্রকরণ, কথন-কৌশল
প্রতিটির ক্ষেত্রে আলাদা। আর থাকে অসামান্য কৌতুকবোধ, যার আড়ালে বাস্তবের
অসঙ্গতিগুলো ধরা পড়ে। আমার আরেকজন প্রিয় লেখক, ক্লারিস লিসপেকটর। এঁর লেখা পড়লে ভার্জিনিয়া উলফের কথা মনে হয়। লেখাগুলো পড়লে মনে হয়, কিছুই যেন ঘটছে না। আসলে যা
ঘটে চরিত্রদের মনের মধ্যেই ঘটে...
No comments:
Post a Comment