বাক্‌ ১৪৮ ।। একটি স্বাভাবিক মৃত্যু ।। রাহুল দাশগুপ্ত

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : সোমবার

 

In which category do you place yourself, in that of fools or that of the mad?

Gustave Flaubert

 

 

মোক্ষ ঠিক আমার সামনেই ছিল। আমি ওকে অনুসরণ করছিলাম। এই করিডর আর সিঁড়ি আমার অচেনা। আর ঠিক তখনই আমার চোখে পড়ল ছবিটা।

এখানে ভিক্টর ত্রিবেদীর ছিব এল কী করে? আমি অবাক হয়ে গেলাম। তারপর ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

মোক্ষ ভিক্টর ত্রিবেদীর ছবি এল কী করে? আমি অবাক হয়ে বললাম। তারপর ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

মোক্ষ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। চুপচাপ ভাবল। তারপর বলল, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। এই শিল্পী একবার আমাদের অফিসে এসেছিলেন। বসের সঙ্গে দেখাও করেছিলেন। বসের নির্দেশেই উনি এই ছবি আঁকেন।

তারপর? আমার খুবই কৌতূহল হচ্ছিল।

তারপর আর কী! ছবিটি ভালো করে দেখ...

আমি ভাল করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে ছবিটি দেখলাম। আমাদের অফিসেরই ছবি। ভেতরের দৃশ্য। একটার পর একটা কাঁচের ঘর। সরু সরু ছায়া ছায়া করিডর। ঘরগুলোর ভেতরে কোনও মানুষ নেই। চেয়ারগুলোতে শুধু মুখোশ রাখা। মুখোশগুলো কালো রঙের। ছায়ার ভেতর ঠিক যেন বোঝা যায় না। আর প্রতিটা মুখোশের পাশে একটা করে রিমোট। তাতে বোঝা যায়, মুখোশগুলো আসলে একেকটা যন্ত্র। রিমোট দিয়ে সেগুলোকে চালানো হয়। আর ডেস্কের ওপর কমপিউটার. সেগুলো অবশ্য বন্ধ। ছবিটা বসের খুব পছন্দ হয়েছিল। তিনি সেটা বাধিয়ে এখানে দেওয়ালে টাঙিয়েও দিয়েছেন। কিন্তু ভিক্টর ত্রিবেদীর বোধহয় একটা কাজের দরকার ছিল। সেটা হয়নি। বস সরাসরি নাকচ করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এই অফিসে আপনার মতো লোককে আমি নিতে পারি না।

কেন?

মোক্ষ এবার একটু জোরেই হেসে উঠল। তারপর বলল, ছবিটা ভাল করে দেখেছ?

বললাম, হ্যাঁ। অফিসের ভেতরের ছবি। কিন্তু কোনও মানুষ নেই।

ওটাই তো মজা। ভিক্টর ত্রিবেদী নাকি বলেছিলেন, অফিসে আবার মানুষ থাকে না কী! শুনে বস খুব হেসেছিলেন। তারপর জানতে চেয়েছিলেন, তাহলে কী থাকে? ভিক্টর ত্রিবেদী নাকি ম্লান গলায় বলেছিলেন, ছবিতে যা দেখছেন, তাই থাকে। এবার বস হো হো করে হেসে উঠেছিলেন। তারপর বলেছিলেন, আপনার চোখটা খুব ভাল। হৃদয়টা আরও ভাল। ওই জন্যই আপনাকে এখানে নেওয়া যাবে না। আপনি পারবেন না। ভিক্টর ত্রিবেদীকে চলে যাওয়ার সময় খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। পরে মকবুলের কাছ থেকে গোটা ঘটনাটা আমরা শুনেছিলাম।

আমি আর মোক্ষ ক্যান্টিনে গিয়ে পৌঁছলা। ক্যান্টিনটা একটা সুসজ্জিত রেস্তারাঁর মতই। আমরা একটা গোল টেবিলের দু-দিকে দু-টো চেয়ার নিয়ে বসলাম। কফি খেতে খেতে আমাদের মধ্যে কথা হচ্ছিল।

আমি বললাম, চাকরিটা বোধহয় ছেড়েই দিতে হবে...

আমি তো রোজ ছেড়ে দেওয়ার কথাই ভাবি।

তাহলে ছেড়ে দাও না কেন?

দেব। আর বেশিদিন এখানে থাকব না। প্রতিদিন ভাবি, আরও একটা দিন সহ্য করে নিলাম। কিন্তু আর নয়। অনেক হয়েছে। এবার পালাব।

আজ অজিতেশের কথা শুনে আমার মাথা হেঁট হয়ে গেছে। আমরা সবাই চাকর? একথা ও সবার মুখের ওপর বলতে পারল?

কফিতে একটু চুমুক দিয়ে মোক্ষ বলল, চাকর ছাড়া আর কী! চাকরি করতে এসেছি। আমাদের চাকর না বানিয়ে ওরা ছাড়বে কেন?

মোক্ষের এই কথাগুলো আমার বেশ লাগে। ওর কথাগুলো একজন সচেতন মানুষের কথা। বেশ গুছিয়ে, চমৎকারভাবে ভাবতে পারে ও। মনের কথা বলতে পারে। আমার মনটাকে যেন পড়তে পারে। কোনও পরিস্থিতিকে বুদ্ধি করে বিশ্লেষণ করতে পারে।

আমি বললাম, একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে ওরা। কী দাপট নিয়েই না হাঁটাচলা করে। ওদের ভয় সবাই কেঁচো হয়ে থাকে। সবাইকে ওরা বুঝিয়ে দেয়, ওরাই এই অফিসের কেউকেটা। বাকি সবাই চাকর। তাদের দিয়ে যা খুশি করানোর ক্ষমতা ওদের আছে। ওরা যা বলবে, তাই করতে হবে।

মোক্ষ আমার দিকে তাকিয়েছিল। মিটিমিটি হাসছিল।

আমি বলে যাচ্ছিলাম, এখানে কেউ কোনও প্রশ্ন করতে পারে না। কেউ নিজের মতো বা সন্দেহ প্রকাশ করতে পারে না। এখানে সবার কণ্ঠস্বরকে চেপে দেওয়া হয়েছে। কেন? মানুষ কী একটা যন্ত্র? তার কোনও মন নেই? হৃদয় নেই? আবেগ বা অনুভূতি নেই? ওরা যেভাবে কথা বলে, তাতে যে কোনও মানুষের আত্মসম্মানে ঘা লাগতে বাধ্য।

ঠিক বলেছো। মোক্ষ বলল, কিন্তু কী করবে বলো? এই দেশটাই এমন। এখানে ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না। তুমি ছেড়ে দিলে ওদের কিছুই যায় আসবে না। কিন্তু তোমার অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। তোমাকে পেটের জন্য রুজিরোজগার করে যেতে হবে। এই গরিব দেশে সবাই পেটের ধান্দার ঘুরছে। চাকরি এখানে সহজে জোটে না। একটা চাকরির জন্য কয়েকশো লোক ছুটছে। নিজেদের মধ্যে কাড়াকাড়ি, মারামারি করছে। এ-ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চাইছে। এই দেশে সবাই সবার প্রতিযোগী, শত্রু, প্রতিদ্বন্দ্বী। এখানে তুমি কোনও বন্ধু পাবে না। তারা তোমাকে পিষে মেরে দিতে চাইবে। কিন্তু কেউ কোনও সাহায্য করবে ন। তোমাকে সামান্য সম্মানটুকুও দেবে না। রাষ্ট্র কেন এরকম পরিস্থিতিকে তৈরি করে রাখে জানো? যাতে মানুষের অবসর না থাকে। যাতে মানুষ চিন্তা করতে না পারে। যাতে মানুষকে সামান্য পেটের ভাত জোটাতেও রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। রাষ্ট্রের দয়া ও করুণার ওপর। এদেশে যে যত বেশি চিন্তা করে, রাষ্ট্র তাকে তত বেশি কোনঠাসা করে দেয়। মানুষ যত ভয় পেয়েছে, রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও দুর্নীতি তত নিরঙ্কুশ হয়ে উঠেছে। এরা মানুষের এই অবস্থার কথা জানে। মানুষ কতটা অসহায় ও এদের ওপর নির্ভরশীল, এরা সেটা জানে। আর তারই সুযোগ নেয় এরা। একেবারে ভূতের মতো ঘাড়ে চেপে বসে। আর প্রতি মুহূর্তে ঘাড় মটকে দেওয়ার ভয় দেখায়। মানুষ যত ভয় পাবে, তত এদের লাভ। তত এদের নিজেদের ক্ষমতা দেখাতে, কর্তৃত্ব করতে সুবিধা কারণ, তারা জানে সহ্য না করলে তারা টিঁকে থাকতে পারবে না। এখানে ভয় আছে, আবার নিরাপত্তাও আছে। কিন্তু চাকরি না থাকলে ভয়টা থেকেই যাবে, কিন্তু নিরাপত্তা থাকবে না। তখন পেট চলবে কী করে? তখন পেট চালানোর জন্য যা করতে হবে, তার ভয় এই ভয়ের চেয়ে অনেক বেশি। তাই লোকে এই ভয়টুকু মুখ বুঁজে সহ্য করে নেয়...

আমি চুপ করে শুনছিলাম। এবার বললাম, এইভাবে আস্তে আস্তে মানুষ নির্বোধ ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত বনে যায়? তাই তো? মানুষ যদি রিঅ্যাক্ট না করে, তারপরেও কী সে মানুষ থাকে?

একটু দূরে অনুরণন বসে আছে। একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ও আমাকে কিছু বলতে চায়? ওর মৃত্যুটাই তো একটা স্টেটমেন্ট। মোক্ষ যা বলছে, তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ ও নিজে। আত্মহত্যা করে ও দেখিয়ে দিয়ে গেছে, মোক্ষের কথাগুলো কতটা ঠিক, বাস্তবোচিত, প্রাসঙ্গিক।

আমার মাথা হেঁট হয়ে গেল। বললাম, কিন্তু বস তো এরকম নয়? এই লোকগুলো কারা? এরা নিজেরাও তো চাকর! বসের চাকর! তাহলে এরা এই মাতব্বরি করার সাহস পায় কোত্থেকে? কে দেয় এদের এই ক্ষমতা? বস কী এসব জানেন না? তিনি এসব বন্ধ করতে পারেন না?

মোক্ষ আবার মিটিমিটি হাসে। তারপর বলে, তুমি ঠিকই বলেছো, এরা নিজেরাও চাকর। আর তা থেকেই এটা বোঝা যায় যে, বসের প্রশ্রয় ছাড়া এখানে কিছুই হয় না। বসকে দেখা যায় না। তিনি সামনে আসেন না। কিন্তু এই গোটা অফিশে কোথায় কী ঘটছে, তার সবই তিনি দেখেত পান। গোটা অফিসে কয়েক হাজার ক্যামেরা লাগনো আছে। সেগুলোই বসের চোখ। অতএব বসের এসব বন্ধ করার প্রশ্নই ওঠে না। বরং তিনি চান বলেই, এগুলো ঘটে চলেছে। এই লোকগুলোর এত সাহস, এত দাপট, এত ক্ষমতা। মানুষের সঙ্গে এইভাবে অসভ্যতা করে যায় এরা। নিরন্তর মানুষকে অপমান করে। মনুষ্যত্বকে অপমান করে। বস সবাই দেখতে পান। তিনি চাকরদের মধ্যে কয়েকজনকে বেছেবুছে ছোট ছোট বস বানিয়েছেন। আগেকার দিনে জমিদাররা যেমন নিজেরা জমিদারিতে থাকতেন না। তাঁদের হয়ে তাঁদের নায়েবরাই প্রজাদের ওপর নানা অত্যাচার চালাত। এইটুকু অতিরিক্ত সুবিধা বস এদের দিয়েছেন। বিনিময়ে এরা বসকে দিয়েছে পরিপূর্ণ আনুগত্য আর স্তাবকতা। প্রশ্ন হল, কেন বস চাকরদের মধ্যে থেকে বেছে বেছে কিছু ক্ষুদ্র প্রভু তৈরি করেছেন? এই ক্ষুদ্র প্রভুদের কাজগুলো কী কী? এরা গোটা অফিসে একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে রাখে। মানুষের মধ্যে সাহস কমে গেলে তার আর কী করার থাকে? বাধ্য হয়ে অত্যাচার সহ্য করা ছাড়া? এরা ঠিক তাই করে। তাছাড়া এই ক্ষুদ্র প্রভুরা শিকারির মতো চোখে একদিকে যেমন গোটা অফিসে নজরদারি চালায়, তেমনি নিজেদের ঘিরে ছোট ছোট দল তৈরি করে রাখে। যে যাকে বাড়তি সুবিধা দেয়, সে তার দলে ভিড়ে যায়। ফলে সাধারণ কর্মীরা জোট বাঁধতে পারে না। বরং তারা মনে মনে একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র শানায়। ষড়যন্ত্র করে। নিজেদের মধ্যে লড়তে গিয়ে নিজেদেরই তারা দুর্বল করে ফেলে। তাদের সাহস কমে যায়। তাদের মধ্যে নিরাপত্তার অভাব তৈরি হয়। আর যত এসব হয়, তত এদের নির্ভরতা বাড়ে শাসকদের ওপর। তত এদের বশ্যতা বেড়ে যায়। শাসকদের চোখে পড়ার জন্য নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। পাশের লোকটিকে শত্রু মনে হয়, কিন্তু মদত দেওয়ার জন্য ওপরে থাকা লোকটিকে বন্ধুর মতো লাগে। এতে শাসকদের হাতই আর শক্ত হয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক যত ধসিয়ে দিতে পারবে, শাসকদের শাসনের ভিত ততই আরও শক্ত হবে। তাদের বিরুদ্ধে মানুষ জোটবদ্ধ হতে পারবে না। বরং নিজেদের মধ্যে শত্রুতা করেই নিজেদের শক্তিকে ক্ষয় করে ফেলবে। সাধারণ কর্মীদের এইভাবে নিজেদের ক্ষয় করিয়ে নেওয়ার জন্য কিছু প্রত্যক্ষ মদত প্রয়োজন। আর এই কাজটিই করে এইসব ক্ষুদ্র প্রভু।

তাহলে আমার কী করা উচিত?

কিছুই করার নেই। মোক্ষ কাঠ কাঠ গলায় বলল, তুমি না চাইলেও, ওরা তোমাকে কোনও না কোনও দলে ঠেলে দেবে। তাছাড়া দেবেই বা বলছি কেন! দিয়েওছে এতক্ষণে।

সে কী! আমি চমকে উঠলাম। কার দলে ফেলেছে আমাকে?

মকবুলের দলে। মোক্ষ শেষ চুমুকটা দিতে দিতে বলল।

 

মকবুল আগেই বেরিয়ে গেছে। সঙ্গে মোক্ষ। ওর অবশ্য অন্য কারণ রয়েছে। বাবাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবে। মকবুলের ওখানে ও তাই যেতে পারবে না। আগেই জানিয়ে দিয়েছে।

কাজ শেষ করে আমি অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় দময়ন্তী এল। সারাদিনে এই প্রথম। বলল, মকবুলের ওখানে যাব না?

হ্যাঁ, যাব তো।

চল তাহলে।

কীভাবে যাব? আমি জানতে চাইলাম।

কেন, অফিসের গাড়িতে। সবাই তো তাই যাচ্ছে।

ঠিক আছে।

আমি ব্যাগপত্র গুছিয়ে রেডি হয়ে গেলাম। আমরা দু-জন সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম। কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। একটা দিনেই দময়ন্তী যেন অনেকটা দূরে সরে গেছে।

অন্ধ গলির ঠিক মুখেই সাদা অ্যাম্বাসাডারটা দাঁড়িয়েছিল। দময়ন্তীকে দেখেই কেউ যেন গাড়ির পিছনের সিট থেকে চেঁচিয়ে উঠল, চলে এসো দময়ন্তী। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি।

গলাটা চিনতে পারলাম। অগ্নিমিত্রের গলা।

দময়ন্তী ছুটে গাড়িতে উঠে পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গেই গাড়িটা স্টার্ট দিল। দময়ন্তী বলে উঠল, আরে, আমার সঙ্গে তো চেরাবও আছে।

কিন্তু গাড়িতে তো আর জায়গা নেই। সামনের সিট থেকে পেছন ফিরে কে যেন বলে উঠল। গলাটা চিনতে পারলাম। নির্ঝর।

এবার আবার অগ্নিমিত্রের গলা পেলাম। সে বলল, ও বাসে চলে যাবে।

চোখের নিমেষে অ্যাম্বাসাডারটা উধাও হয়ে গেল। গাড়িতে জায়গা ছিল। পেছনে অনায়াসে তিনজনে বসে যাওয়া যেত। কিন্তু অগ্নিমিত্রেরর বোধহয় দময়ন্তীকে একা পেতে চায়। অফিসে আর কেউ নেই। একরাশ অন্ধকারের মধ্যে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। নিজেকে খুব দুর্বল মনে হচ্ছিল। আর অসম্ভব অপমানিত। আরও কী কিছু ছিল? দময়ন্তীকে ঘিরে, আলাদা কোনও অনুভূতি? একটা শূন্যতা, ফাঁকা ফাঁকা ব্যাপার। বুকের ভেতরটা যেন হু হু করে উঠছিল।

করার মানুষ আমি নই। কিন্তু যেতে আর ইচ্ছা করছে না। পা ভারী হয়ে উঠছে। চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। রাস্তা চিনতে পারছি না। মকবুল আমাকে ভালো করেই বুঝিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, কিছুতেই যেন পৌঁছতে পারব না।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম। একটা ঘিঞ্জি এলাকা। তার ভেতর দিয়ে সরু পথ। মানুষ এখানে থাকে। কিন্তু এক ঝলক দেখলে, বাজার এলাকা বলেই মনে হয়। লোকজন ব্যস্ত হয়ে এদিকওদিক ছোটাছুটি করছে। রাস্তার ওপরই খাটিয়া পেতে কেউ শুয়ে আছে, কেউ মাংস ভাজছে, কেউ স্নান করছে সারা গায়ে সাবান মেখে, কোনও দরজায় উঁকি দিচ্ছে মা, তাকে ঘিরে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট বাচ্চা। মনে হল, এত শব্দের মধ্যে মকবুল থাকে কী করে? আর একটু নির্জন জায়গা সে বেছে নিতে পারত না? সে না সুফি চর্চা করে!

মকবুল আমাকে দেখেই সাদরে অভ্যর্থনা করল। নিজের স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। দেখলাম, ভদ্রমহিলা একটু খুঁড়িয়ে হাঁটেন। কৌতূহলী হয়ে তাকাতেই মকবুল বলল, ওর এই পা-টা একটু ছোট। ভদ্রমহিলা কিন্তু বেশ মিষ্টি দেখতে। আমি খেতে বসলাম। অফিসের অনেককেই দেখতে পেলাম। কিন্তু দময়ন্তী কোথায়? মকবুল আমাকে স্পর্শের পাশে বসিয়ে দিল। স্পর্শ তখন মন দিয়ে পরোটা আর মাংস খাচ্ছে। আমাকে দেখে সে-ও খুব খুশি হল।

খাওয়া-দাওয়ার পর আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। এখান থেকে দূরে সমুদ্র দেখা যায়। আশেপাশের এলাকাটা যদিও খুবই ঘিঞ্জি। হঠাৎ কে যেন আমার কাঁধে হাত রাখল। পিছনে তাকাতেই দেখলাম, দময়ন্তী। আমাকে দেখেই বলল, চলো, এই বেলা পালিয়ে যাই।

তোমার খাওয়া হয়ে গেছে?

অনেকক্ষণ। আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।

কেন? আমার কৌতূহল হল।

তোমার সঙ্গে ফিরবে বলে।

বারান্দার পাশেই গ্রিল দেওয়া। তাতে তালা দেওয়া নেই। বাইরে বেরোলেই সিঁড়ি। আর তারপরই মুক্তি। আমরা বেরিয়ে এলাম।

দময়ন্তী বলল, চলো, তোমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাই।

একটা নির্জন রাস্তা দিয়ে আমরা হাঁটছিলাম। নিজেকে আর লুকোতে পারলাম না। বললাম, ওরা তাহলে তোমার জায়গা বদলে দিল!

হ্যাঁ, তাই তো দেখলাম। দময়ন্তী নির্বিকারভাবে বলল।

কেন? তোমার কী মনে হয়?

দময়ন্তী একটু অবাক হয়ে তাকাল। তারপর বলল, কী আর মনে হবে? অগ্নিমিত্র চায়, ওর সামনে বসে সারাদিন আমি টাইপ করে যাই। আর ও বসে বসে দেখে। এটাই কারণ।

তোমার এতে অস্বস্তি হয় না? তারপর ধরো গাড়িতে যা করল। তুমি কিছু বলো নি?

কী বলব! দময়ন্তী একইরকম নির্বিকার। একটু চুপ থেকে বলল, অফিসে চাকরি করতে গেলে মেয়েদের এরকম একটু-আধটু সহ্য করতে হয়। এ নিয়ে বলার কী আছে?

আমি আর কিছু বললাম না। আর কী বলার থাকতে পারে! দময়ন্তী গোটা ব্যাপারটা বেশ এনজয় করছে। আমার কী অসুবিধা হচ্ছে, তা ওকে বলে কী লাভ?

সমুদ্রের ধারে আমরা এসে গেছি। এখানে সারি সারি মার্বেলের মূর্তি। একটা সিমেন্টের চাতাল। তারপরই বালি আর বালি। সেই বালির গায়ে আছড়ে পড়ছে সাদা ফেনা। আমি আবার বেহালার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। এখানে কে বাজাচ্ছে বেহালা?

দময়ন্তী বলল, কেমন জায়গাটা?

চমৎকার।

আগে এসেছো?

উঁহু। জানতামই না।

আমি একটা গাছের তলায় বসলাম। গোটা জায়গাটাই অন্ধকার। দময়ন্তী আমার পাশে বসল। সমুদ্রের বাতাস ঝাপটা মারছে আমাদের মুখে। ওই মার্বেলের মূর্তিগুলির মধ্যে বেশিরভাগ নারী মূর্তি। তাদের শরীরটা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। ইচ্ছা করলেই উঠে গিয়ে ওদের যে কোনও স্তন আমি স্পর্শ করতে পারি।

দময়ন্তী জলের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ বলে উঠল, আমি জানি তুমি কী চাও।

আমি ওর দিকে তাকালাম। আবেগে আমার গলা বুজে আসছে। কী করতে পারি আমি এখন? কিছুক্ষণ ধরেই আমি উসখুশ করছিলাম। তীব্র একটা অস্থিরতা জন্ম নিচ্ছিল আমার মধ্যে। ও নিশ্চয়ই সেটা লক্ষ্য করেছে। বেহালার সুরটা তীব্র হয়ে উঠেছে হঠাৎ।

দময়ন্তী ওর গালটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। ওর বাঁ-গাল। আমি সেই গালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। ওর গাল খুব নরম, ফোলা আর তীব্র আবেদনে পূর্ণ।

দময়ন্তী বলল, ভাল লেগেছে?

ওরা গলার স্বর শুনে চমকে উঠলাম। বেহালার সুর আচমকা স্তব্ধ হয়ে গেছে। অসম্ভব চুপচাপ চারপাশে। তীব্র শ্লেষ ওর গলায়। চাবুকের মতো আছড়ে পড়ল আমার কানে। যেন ও বোঝাতে চাইল, তোমাকে আমি চিনে গেছি। সব পুরুষ যা চায়, তুমিও ঠিক তাই চাও। তুমি কারও চেয়ে অন্যরকম কিছু নও...

একবার মনে হল, অগ্নিমিত্র কী ওকে কিছু বুঝিয়েছে?

ঠিক তখনই একটা মার্বেলের মূর্তির পিছন থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল কালো ঘোড়াটি। তারপর ঝড়ের বেগে ছুটে গেল সামনের দিকে। সমুদ্রের সামনে গিয়ে ধাই করে সে হঠাৎ পিছন ফিরল। আর স্থির দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে।

 

 


No comments:

Post a Comment